কৌশল পাল্টেছে শিকারিরা, ফাঁদ-বিষটোপে মরছে পাখি

প্রকাশিত: ৭:১৩ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০২৩

কৌশল পাল্টেছে শিকারিরা, ফাঁদ-বিষটোপে মরছে পাখি

মৌলভীবাজার সংবাদদাতা
বন্ধ হচ্ছে না মৌলভীবাজারের হাওর বাওড়ে পাখি শিকার। নানা ফন্দিতে শিকারিরা শিকার চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো বিষ টোপ আবার কখনো রাতের আঁধারে ফাঁদ পেতে শিকার অব্যাহত রেখেছে। শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিযায়ীরা আসতে শুরু করে মৌলভীবাজারের হাওরগুলোতে। তারা তাদের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয় মৌলভীবাজারে অবস্থিত এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ হাওর হাকালুকিকে। এছাড়া কাউয়াদীঘি ও হাইল হাওরের বিলঝিলেও এরা অবস্থান নেয়।
সুযোগ বুঝে এ সময় এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি বেশি লাভের আশায় নেমে পড়ে পাখি শিকারে। রাতের আঁধারে শিকার করে তারা পাখিগুলো বিক্রি করে দেয়। ভোজনবিলাসীরা চড়া দামে এসব পাখি কিনেও নেন। সম্প্রতি কর্তৃপক্ষের নজরদারির কারণে কৌশল পাল্টেছে শিকারিরা। রাতের আঁধারে স্পট দেখে দেখে তারা ফাঁদ ও বিষটোপ দিয়ে রাখে। ভোর হওয়ার আগেই শিকার হওয়া পাখিগুলো জবাই করে বাজারের ব্যাগে করে শহরের বাসা বাড়িতে বিক্রি করে।
পাখি শিকার বন্ধে বন বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর উদ্যোগ নিলেও কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না পাখি শিকার। পরিবেশকর্মী ও পাখি প্রেমিসহ হাওরপারের লোকজন পাখি শিকার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন।
কাউয়াদীঘি হাওর পারের স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর শীতপ্রধান দেশ থেকে হাকালুকি ও কাউয়াদীঘি হাওরে নানা প্রজাতির পাখি যেমন গুটি ইগল, বালিহাঁস, ভুতিহাঁস, গিরিয়াহাঁস, ল্যাঞ্জাহাঁস, সরালি, পানভুলানি, কালিম আসে। বিদেশি পাখির পাশাপাশি দেশি প্রজাতির নানা জাতের পাখিও রয়েছে এই হাওরগুলোতে।
সম্প্রতি হাকালুকি হাওরে বিষটোপ দিয়ে হাঁস শিকার করে ভাগবাটোয়ারার ঘটনা বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের গঠিত দুই সদস্যের তদন্তে প্রমাণিত হয়। এ ঘটনায় হাকালুকি বিটের দায়িত্বে থাকা বনপ্রহরী মোতাহার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়ায় তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মৌলভীবাজার বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শ্যামল কুমার মিত্র বলেন, হাকালুকি হাওরে পাখি শিকার করে ভাগবাটোয়ারার ঘটনাটি তদন্তে প্রাথমিকভাবে আমরা প্রমাণ পেয়েছি। এতে হাকালুকি বিটের দায়িত্বে থাকা বনপ্রহরী মোতাহার হোসেনের সংশ্লিষ্ট পাওয়া গেছে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেব।
বন্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, হাকালুকি হাওরে পাখি শিকারের ঘটনাটি তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পেয়েছে কমিটি। এই ঘটনায় হাকালুকি বিটের দায়িত্বে থাকা বনপ্রহরীর সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এছাড়া পাখি শিকারের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানা গেছে, হাকালুকি হাওরের একটি বিল থেকে তালিমপুর ইউপির মুর্শীবাদকুরা গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে মো. হুসেন আহমদ বিষটোপ দিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক হাঁস পাখি শিকার করেন। সকালে তিনি পাখিগুলো বস্তায় ভরে স্থানীয় কাননগোবাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। খবর পেয়ে হাকালুকি বিটের দায়িত্বে থাকা বনপ্রহরী মোতাহার হোসেন পাখিসহ হুসেনকে আটক করে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারের কাছে নিয়ে যান। পরে তাদের সামনে ‘ভবিষ্যতে এ ধরনের গর্হিত কাজ করবেন না’ মর্মে হুসেন মুচলেকা প্রদান করেন। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, শিকারিকে ছেড়ে দেওয়ার পর প্রায় অর্ধশতাধিক হাঁস পাখি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা ‘ভাগবাটোয়ারা’ করে নেন। আর শিকারি হুসেনের কাছ থেকে লিখিত মুচলেকায় মাত্র তিনটি পাখির কথা উল্লেখ করা হয়। মূলত শিকারিকে বাঁচাতে অর্ধশতাধিক পাখি শিকারের প্রকৃত তথ্য গোপন করেন বনপ্রহরী মোতাহার হোসেন। এর সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত ছিলেন। কাউয়াদীঘি হাওরের বিভিন্ন এলাকায় পাখি শিকারিদের পাখি বিক্রি করতে দেখা গেছে।
কথা হলে হাওরপারের আব্দুল হান্নান কয়ছর মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, বন্দুক দিয়ে শিকার বন্ধ হলেও কাউয়াদীঘি হাওরের বড়ধলের বন্দ, মান্দার বন্দ, বৈচাবিল, ওন্যাবিল ও কাগজি বাড়ি চরউয়া এলাকায় অসাধু শিকারিরা বিষটোপ ও ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করেন।
পরিবেশকর্মী পাখিপ্রেমি মুরাদ আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, অবাধে পাখি শিকারের কারণে হাওরে পাখির সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। পাখি রক্ষায় জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাখি শিকার বন্ধে প্রসাশনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাখি রক্ষায় স্থানীয় লোকদের সম্পৃক্ত করতে হবে।
সমাজকর্মী আলমগীর হোসেন ও গউছ আহমদ গণমাধ্যমকে বলেন, হাওরপারের নতুন সোনাপুর, ইসলামপুর, কাশিমপুর গ্রামের অসাধু ব্যক্তিরা পাখি শিকারে জড়িত। এরা রাতের আঁধারে বিষটোপ ও ফাঁদ পেতে পাখি শিকার করে ভোরে বিভিন্ন ফরিয়াদের কাছে এগুলো বিক্রি করে। তারা নানা কৌশলে শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে এগুলো সরবরাহ করে। অতি লাভের জন্যই এরা এমন কাজ করে।
বন্যপ্রাণি ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, জনবল সংকটের কারণে প্রত্যান্ত অঞ্চলে পাখি শিকার বন্ধের পদক্ষেপ নিতে পারিনি। মাঝেমধ্যে আমরা বন্দুক দিয়ে পাখি শিকারের খবর পাই। এ ব্যাপারে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছি। এরপরও যদি কেউ পাখি শিকার করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর