ঢাকা ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:০৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫
হেলাল আহমদ, বালাগঞ্জ
বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, স্বামী পরিত্যাক্তা ও বিধবা এই চার ক্যাটাগরিতেই ভাতা পাওয়ার যোগ্য ৭০ বছর বয়সী ময়বুননেছা। অথচ, এর একটিতেও ভাতা পাচ্ছেন না অসহায়, হতদরিদ্র, স্বামী-সন্তানহীন এই বৃদ্ধা। অর্থাভাবে মানবেতর দিন পার করলেও সরকারি সব রকম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন তিনি।
সর্বহারা এই ময়বুননেছা সিলেট জেলার বালাগঞ্জ ঊপজেলার পূর্ব গৌরীপুর ইউনিয়নের মৈশাসী গ্রামের মৃত ইউসুফ আলীর মেয়ে। ৭০ বছর বয়স্ক এই বৃদ্ধার স্বামী, সন্তানসহ নিকট আত্মীয় বলতে কেউ নেই। জাতীয় পরিচয়পত্র (৯১১০৮৭০৬৪৬৩৩৩) অনুযায়ী ময়বুনের জন্ম ১৯৫৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর থেকেই ভোট দিয়ে কত সরকার পাশ করিয়েছেন তা মনে নেই। আসন বদলেছেন কত কত চেয়াম্যান-মেম্বারও। কিন্তু ভাগ বদলায়নি ময়বুননেছার। ভোটের সময় ধরনা দেওয়া প্রার্থীরাও নির্বাচনের পর ভুলে যান ময়বুনের কথা। যার ফলশ্রুতিতে ইউনিয়ন কিংবা উপজেলার সাহায্যের তালিকায় নেই ময়বুনের নাম। বৈধভাবে চারটি ক্যাটাগরির সব কয়টিতেই ভাতা পাওয়ার যোগ্যতা থাকলেও তাকে দিনের পর দিন বঞ্চিত করা হচ্ছে সরকারি এই সেবা থেকে।
স্থানীয়রা জানান, ময়বুননেছার বাড়ি বলতে একটি কুড়ে ঘর, তাও নড়বড়ে। ছোট একটি রুম। তাও অন্ধকার ও মেজে সেঁতসেঁতে। পাশের রুম গোয়াল ঘর। সেখান থেকে প্রতি নিয়ত দুর্গন্ধ আসছে। রুমে ছোট একটি খাট, অল্প হাড়ি পাতিল। ক্ষুধার্ত হলে তিনি নিজেই রান্না করেন। মাঝে মাঝে বয়সের কারনে রান্নাও করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে পাড়ার কিশোরী মেয়েরা সহযোগিতা করেন। ঘরে বিদ্যুৎ নেই, নেই শৈৗচাগার। ৭০ বছর বয়স্ক ময়বুননেছার কষ্টের জীবনের কিছুটা অনুভব করেন এ প্রতিবেদক। তিনি ময়বুননেছার সাথে সরাসরি কথা বলতে চান, দেখা করতে চান, কিন্তু প্রতিবেশীরাও বলতে পারেন না কোথায় বা কার বাড়িতে অবস্থান করছেন ময়ুবন।
প্রতিবেশীরা জানান, তিনি বাড়ীতে থাকেন না। এ বাড়ি, ও বাড়ি চলে যান। এভাবেই কাটে সারা দিন্ খাওয়া চলে অন্যদের বইড়তে। সবাই তাকে ভালোবাসেন।
কিন্তু দেখা করতে নাছোড়বান্দা প্রতিবেদক হেলাল জানান, ‘উনাকে খোঁজে দিতে পাড়ার শিশুদের সহযোগিতা নিয়ে তাদের কয়েকজনকে কয়েক দিকে প্রেরন করি। সন্ধান পাওয়া গেলে, শিশুদের নিয়ে শুরু হলো হাটা। সময় তখন বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে। ৩/৪ ফুট উচ্চতার ময়বুননেছা হেটে আসছেন লাঠি ভর দিয়ে। পা অনেকটা বাঁকা, তাই স্বাভাবিকভাবে হাটতে ও পারেন না। হাটা থামালাম, এক হাতে লাঠি অন্য হাতে কয়েক পাতা ট্যাবলেট আর ক্যাপসুল। রাস্তায় শুরু হলো কথা।’
কেমন আছেন? প্রশ্নের উত্তরে সহজ সরল উক্তি ‘ভালা না, অসুক’।
প্রশ্ন : ভাতা পাচ্ছেন কি?
উত্তর : কেউ দেয় না।
প্রশ্ন : কীভাবে চলেন?
উত্তর : দেখারা দেখে না, অন্যরা আমারে দেখে, খেতে দেয়, ভালোবাসে।
এমন আলোচনায় জীবন যাপনের অনেক তথ্য জানান ময়বুননেছা। ফর্সা আকাশ সন্ধ্যায় অন্ধকার হয়ে আসছে, ময়বুননেছা অন্ধকারে হেটে ঘরে যেতে কষ্ট হবে ভেবে শিশুদেরকে সঙ্গী করে বিদায় জানাই। এবার কথা হয় গ্রামের বয়স্ক কয়েক জনের সাথে। কথা হয় ময়বুননেছা’র আপন বড় ভাই হাজী মনসুর আলীর সাথে। তারা জানান- ময়বুননেছা বয়স্ক, তাই রান্না করতে পারেন না। অনাহারে কাটে অনেক সময়। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না।
পা বাকা হওয়া সর্ম্পকে আত্মীয়রা জানান- ৫/৬ বছর বয়সে মামার বাড়ি যাবার সময় তিনি মামার কোল থেকে পড়ে গেলে পায়ে আঘাত পান। ভিষন জ্বর ওঠে। সেই থেকে পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। অনেক চিকিৎসা, কবিরাজি করা হয়, পা ভালো হয়নি। বরং দিন দিন বাকা হতে থাকে। বিয়ে হলে সে বিয়ে ঠিকেনি। বাপের বাড়ি চলে আসেন। সেই থেকে একা জীবন। লোকজনের সহযোগিতায় চলছে জীবন।
সেঁতসেঁতে, নড়ভড়ে, কুড়ে ঘরটি যে কোন সময় ঝড়ে ভেঙে যেতে পারে, তাই প্রয়োজন নতুন ঘর। চিকিৎসা প্রয়োজন, ভাতা প্রয়োজন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জানান- এই গ্রাম থেকে বারবার মেম্বার নির্বাচিত হয়েছেন অনেকেই, কেন তারা তাকে ভাতার ব্যবস্থা করে দিলেন না? ময়বুননেছা নিকট আত্নীয় অনেকেই প্রবাসী তা হলে কেন তিনি কুড়ে ঘরে থাকবেন? চাইলে তারা এবং গ্রামের ধনী প্রবাসীরা শৈৗচাগারসহ ঘর তৈরী করে দিতে পারেন।
বালাগঞ্জ উপজেলা অষ্টিটিক প্রতিবন্ধী সেবা কেন্দ্রের সভাপতি, সাংবাদিক শাহাব উদ্দিন শাহিন জানান- ময়বুননেছার জন্য সকলকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ভাতার জন্য সমাজসেবা কর্মকর্তার সাথে আলোচনা করেছি।
বালাগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা জুয়েল আহমদ এর দৃষ্টি আর্কষন করা হলে তিনি জানান- ময়বুননেছার ভাতা পাচ্ছেন না বিষয়টি দুঃখ জনক। দ্রত বয়স্ক ভাতার জন্য সাংবাদিক শাহিনকে বলেছি প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র জমা দিতে। কাগজপত্র পেলে বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করা হবে এবং ভবিষ্যতে অনলাইনের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
ময়বুননেছা’র ভাতা, চিকিৎসা, ঘরের জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক উদ্যোগ। সঠিকভাবে উদ্যোগ নিলে অর্থ কোন সমস্যা নয়। ময়বুননেছার উচ্চতা ৩/৪ফুট। হয়তো তিনিই হবেন দেশের সব চেয়ে বয়স্ক খাটো মহিলা। জীবনের শেষ সময়ে ময়বুননেছা সুস্থ্য থাকার জন্য ঔষধ, ভালোভাবে থাকার জন্য শৌচাগারসহ একটি ঘর প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আত্মীয় স্বজন, গ্রামবাসীসহ সমাজের ধনী এবং প্রবাসীদের সহযোগিতা কামনা করছি। আমরা সবাই এগিয়ে আসলে আশা করা যায়, যতদিন তিনি বেচে থাকবেন তত দিন একটু ভালো পারবেন। আসুন আমরা সবাই মিলে ময়বুননেছা’র জন্য কিছু একটা করি। আর্থিক সহযোগিতার তথ্য বালাগঞ্জ বার্তায় প্রকাশ করা হবে।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host