ঢাকা ৭ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২২শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:৪৬ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৪, ২০১৯
নিজস্ব প্রতিবেদন : সুনামগঞ্জের এক এক করে সবকটি বিল দখল করে নিচ্ছেন আলোচিত ব্যবসায়ী জিয়াউল হক। এর আগে শ্মশান,সংখ্যালঘুর ভুমিসহ একাধিক ব্যক্তির বাসাবাড়ি দখলের অভিযোগও উঠে তাঁর উপর। বর্তমানে জিয়াউল হকের দখলকৃত হাওরগুলো হচ্ছে জোয়াল ভাংগার হাওর, লাইয়া গজারিয়া গ্রুপ জল মহাল, করচা নদী গ্রুপও ছনুয়া বনুয়া বিল। এই বিলগুলোর অবস্থান সদর থানায়। অন্য দুটি বিল হচ্ছে বগিয়াদী গ্রুপ জলমহাল ও সোনাতলা বিল । এই দুটি বিলের অবস্থান জেলার তাহিরপুর উপজেলায়।
অভিযোগ উঠেছে, এই বিলগুলো স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠনের নামে প্রথমে তিনি লিজের জন্য আবেদন করেন। লিজ কার্যকর হবার পর সব কিছু চলে আসে জিয়াউল হকের নিয়ন্ত্রণে। লিজগ্রহীতা মৎস্যজীবী সংগঠনের লোকেরা সারাদিন মৎস্য শিকার করলেও দিন শেষে তাদের ভাগ্যে জোটে কেবল নামমাত্র পারিশ্রমিক। এই ব্যবস্থার ফলে সরকারের ২০০৯ এর জলমহাল নীতি লংঘন করা হলেও কার্যকর পদক্ষেপ নেই সংশ্লিষ্ট মহলের। পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের নাম ভাঙ্গিয়ে জিয়াউল হক একাই সামাল দিচ্ছেন নিয়ন্ত্রক সংস্থা। সাথে সহযোগীতা রয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলোচিত মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের।
জানাগেছে, মৎস্যজীবীদের জীবন মান উন্নয়নের লক্ষে হাওরাঞ্চলের মৎস্য সম্পদকে বিকল্প পেশা হিসাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতি ২০০৯ প্রনয়ণ করা হয়। ‘জাল যার, জলা তার’- এই নীতির আলোকেই প্রকৃত মৎস্যজীবিদের সংগঠন/সমিতির নামে সরকারি জলমহাল গুলো ইজারা বন্দোবস্থ দেওয়া হয়। অথচ দীর্ঘদিন যাবত সুনামগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সদস্য জিয়াউল হক সরকারের চোখ ফাঁকি দিয়ে হাওরের মৎস্য জীবিদের নামে জলমহাল ইজারা নিয়ে সম্পুর্ণ অবৈধ ও বেআইনি ভাবে সাবলীজের জলমহাল গুলো ভোগদখল করে মৎস্য জীবীদের কোটি কোটি টাকা লোটপাট করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছে। সরকারি জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ২০০৯ এর ধারা ৫ এর উপধারা (৪) এর (ঢ) তে উল্লেখ আছে ‘লীজ গ্রহীতা কোন মৎস্যজীবী সমিতি/সংগঠন তাদের নামে লীজকৃত জলমহাল কোন অবস্থাতেই সাবলীজ অথবা অন্য কোন ব্যক্তি/গোষ্ঠীকে হস্থান্তর করতে পারবে না এবং অন্য কোন উপায়ে তা ব্যবহার করতে পারবে না। যদি তা করে থাকে,তাহলে জেলা প্রশাসক উক্ত লীজ বাতিল করে জমাকৃত লীজ মানি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করবেন।’
হাওরের মানুষের দাবী হলো- জলমহালগুলোর ইজারা বাতিল করা হলে প্রকৃত মৎস্য জীবীরা তাদের অধিকার ফেরত পাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের জীবন জীবীকার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে।
এদিকে, জিয়াউল হক তার চতুর কৌশলের মাধ্যমে সুনামগঞ্জের কৃষকদের রক্ত শোষণ করে যাচ্ছে। কৃষকদের জীবন মান উন্নয়ন,কৃষি উন্নয়নে সহায়তা ও হাওরের প্রান্তীক কৃষকদের উৎপাদন এবং ভর্তুকির অংশ হিসাবে সরকার প্রতি বছর হাওরের প্রান্তীক কৃষকদের কাছ থেকে বাজার মূল্যের দিগুণ দামে ধান ও চাল ক্রয় করে থাকেন। কিন্তু সরকারের দিগুণ মূল্যে ক্রয় করা ধান চাল সংগ্রহের অভিযান বঞ্চিত হচ্ছে জিয়াউল হকের কারণে। আলোচ্য জিয়াউল প্রভাবশালী একটি মহলের আনুকুল্যে নিয়ে সিন্ডিকেট করে কৃষকদের নামে জেলার সুনামগঞ্জ সদর,বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর,জামালগঞ্জ,ধর্মপাশা,মধ্যনগর,দঃসুনামগঞ্জ ও দোয়ারাবাজারসহ ৭ টি উপজেলার খাদ্যগুদামে নামে বেনামে ধান ও চাল সরবরাহ করে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত প্রান্তীক কৃষকরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জিয়াউল হক এতই প্রভাবশালী যে, কেউ তার এসব অপকর্মের প্রতিবাদ করলে তাকে মামলা হামলা করে হয়রানি করে জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে।
সুনামগঞ্জ-১ আসনের এম পি মোয়াজ্জেম হোসেন রতন ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের পি এস হাসনাতের সহিত রয়েছে জিয়াউলের বিশেষ সখ্যতা। তারা জিয়াউল হককে সকল অপকর্মে সহযোগিতা করে নিজেদেরও পকেট ভারি করে নিচ্ছে । বিগত জামাত – বি এন পি জোট সরকারের সময় বি এন পির হুইপ ফজলুল হক আসপিয়ার বিশ্বস্থ খলিফা হিসাবে জিয়াউল জেলার জলমহাল,বালু মহাল,ধানচাল খাদ্য গুদাম,বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে নিয়োগ বানিজ্য একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করে অবৈধ সম্পদের পাহার গড়েছে।
এদিকে, সুনামগঞ্জের জিয়াউল হকের দখল বাণিজ্যে একাধিক লোকজন সুনামগঞ্জ নিজ বাসা বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেও কারো পক্ষে সুবিচার পাওয়া সম্ভব হয়না। এমনি এক অভিযোগ নিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে পালিয়ে এসে সিলেট দুর্নীতি দমন কার্যালয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন শাহীন চৌধুরী নামের জনৈক ব্যক্তি। দুদকে দায়ের করা অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, সুনামগঞ্জের তেঘরিয়া গ্রামের নুরুল হকের ছেলে এই জিয়াউল হক। যৌবনে জিয়াউল হকের পিতা নুরুল হক পান বিক্রী করে জীবিকা চালাতেন। একসময় পেশা বদল করে চলে যান ফল বিক্রীতে। পাশাপাশি শুরু করেন সুদ ব্যবসা। এই বিষয়গুলো জানিয়েছেন, তেঘরিয়া এলাকার লোকজন। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস না পেয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্ত জোড়ে দেন সকলেই। সেই জিয়াউল হকের পরিবারে একটা সময় তেমন আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও তিনি এখন প্রায় হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক।
দুদকে দায়ের করা অভিযোগে শাহীন চৌধুরী উল্লেখ করেন, সুনামগঞ্জের যাদুকাটা, ওয়েজখালী নদী থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে জিয়াউল হক অবৈধ বালু পাথর উত্তোলন করেন। সাথে রয়েছে টেন্ডারবাজী ও চাঁদাবাজীসহ নানা অপকর্ম। জিয়াউল হকের বাহিনীতে নিযুক্ত রয়েছেন শহরের দাগি একাধিক অপরাধী। এই বাহিনীর মধ্য দিয়েই সকল অপকর্ম নির্বিঘ্নে চালাতে সমর্থ হন তিনি। শহরতলীর সার্কিট হাউজের সামনে জিয়াউল হকের সুইমিংপুল বিশিষ্ট বাড়িটির আনুমানিক মূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ওয়েজখালিতে একটি বাগানবাড়ি রয়েছে-যার মূল্য আনুমানিক ৫ কোটি টাকা। ওয়েজখালিতে রয়েছে হক সুপার মার্কেট, হক অটো রাইস মিল, শহরের ট্রাফিক পয়েন্ট সংলগ্ন দাস ব্রাদার্স, দেশবন্ধুসহ নামে-বেনামে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এখানেই শেষ নয়, সদর থানার গৌরারং ইউনিয়নের শনির হাওর,খরচার হাওর ও লাইয়ার হাওরে আছে অনেকগুলো অবৈধ বিল। সেখানে রয়েছে জমির মালিকানাও। সেখানে নিজের নামে একটি ইটখলাও রয়েছে জিয়াউল হকের।
লিখিত অভিযোগে তিনি জানান, জিয়াউল হকের ষ্টেশন রোডের অফিসটি ছিল বি এন পির অঘোষিত প্রধান কার্যালয় এবং হুইপ আসপিয়ার প্রধান নির্বাচনী অফিস। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে ২০১৪ সালের নির্বাচনের পূর্বে সুনামগঞ্জ ১ আসনের এম পি মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের সহিত অবৈধ ব্যবসা,চাঁদাবাজী সিন্ডিকেট করে সখ্যতা গড়ে তুলে। এর পর থেকে জিয়াউলকে আর পেছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। ধুপাজান ও ফাজিল পুর বালু মহােেল চাঁদাবাজি, পুলিশ নিয়োগে দালালী, থানার দালালী সহ যায়গা দখল, খদ্যগুদামে সিন্ডিকেট করে পঁচা চাল সরবরাহ, কৃষকদের নামে বেনামে গুদামে ধান সরবরাহ করে কোটি কোটি টাকার পাহাড় গড়েছে। সুনামগঞ্জ শহরের সকল সন্ত্রাসীদের নিয়ে একটি বাহিনি গঠন করে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে বালুমহালে চাদাবাজী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের যায়গা দখল করে নামমাত্র মুল্যে নিজের নামে দলিল করিয়ে সুনামগঞ্জ শহরে অল্প সময়ে বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক হয়েছে।
১৯৯৮ সালে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরের পুরোহিত বাবুল রায়কে খুন করে কষ্টি পাথরের মূর্তি চুরি হওয়ার ঘটনায় এলাকার লোকজন জিয়াউলের পরিবারকে সন্দেহ করে থাকেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই ঘটনাটির সুরাহা হয়নি। এভাবে হাওরাঞ্চলে নির্যাতনের মাধ্যমে জিয়াউল পরিনত হয়েছে এক ভয়ঙ্কর রক্তখেকো নরপিশাচ হিসাবে। সুনামগঞ্জের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সহিত আলাপ করলে সকলেই জিয়াউলের অপকর্ম প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর হস্থক্ষেপ কামনা করেন। এবং জিয়াউল কে আইনের আওতায় এনে তার সমগ্র অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধানের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে কৃষক, মৎস্যজীবী ও সাধারণ মানুষ আকুল আবেদন জানান।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by syltech