ঢাকা ২৭শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:১৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৪, ২০২০
সবুজ ভট্টাচার্য্য
আমরা বাঙালিরা খুব অদ্ভুত এক মনমানসিকতা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করি। দিনের শুরুটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ বুলানোর মাধ্যমে শুরু করে, নিজেকে বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন বার বিভিন্নভাবে বিভিন্ন ধরনের আবেগে আপ্লুত করার স্বভাব আমাদের মধ্যে বেশ মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই সেই আমাদের সেই আবেগ, সেই অনুভূতি এবং সেই সচেতনতা সময়ের কাছে হার মানে খুব অল্প সময়ে। সে সময় ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন রকম হয়। যেমন ঘটনাটি যার জীবনে ঘটেছে তার কাছে এবং যারা ঘটনাটি দেখেছেন এবং অনুধাবন করেছেন তাদের কাছে আনুপাতিক হারে ভিন্ন হয়। যার জীবনে ঘটনাটি ঘটেছে সে হয়তো বেশ কিছুদিন সেই ঘটনাটি জন্য নিজেকে ব্যস্ত রাখেন কিন্তু আমরা বাকিদের অতটা সময় কোথায় যে অন্যের চিন্তা নিয়ে এতক্ষণ বসে থাকবো। তাই আমরা যেকোনো ধরনের ঘটনা বেশিদিন মনে রাখিনা। যেমন ধরুন বিশেষ দিনে আমরা বিশেষভাবে বাঙালি হই, বিশেষ দিনে আমরা বিশেষ রকম গান শুনি, বিশেষ সময়ে আমরা বিশেষ রকম আচরণ করি।
গত কয়েকদিন ধরে খবরের কাগজ এবং টিভিতে খবর পড়া বা দেখার সময় যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ছে সেটি হচ্ছে সিলেটের এমসি কলেজ এর ধর্ষণের ঘটনাটি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, সংবাদপত্র, টিভি, রেডিও বেশ সচেষ্ট ভূমিকা পালন করছে এই খবরটি আমাদের চোখের সামনে বারবার আনার জন্য। তবে পরিতাপের বিষয় এই যে এই সব গণমাধ্যম ও খুব বেশিদিন ঘটনাটি নিয়ে পড়ে থাকবে না কারণ তাদের জন্য আরো বড় ধরনের ঘটনা ঘটার জন্য ইতিমধ্যে নীরবে প্রস্তুতি নিচ্ছে। যে বিষয়টা চোখে পড়ল; দেশের মানুষ বেশ আন্দোলনমুখী হয়ে পড়েছে। দেখে এমনটা মনে হচ্ছে যেন সবার মধ্যে রক্ত টগবগ করছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, বাঙালির রক্ত একাত্তরের পর তেমন একটা প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখেনা। নয় মাসের যুদ্ধে বাঙালি অনেকটাই হাঁপিয়ে পড়েছে। এমনকি পূর্বপুরুষদের যুদ্ধের ক্লান্ত দেহের ক্লান্তিভাব উত্তরাধিকারসূত্রে আমরা পেয়ে গেছি তাই কোন কিছু অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মাঠ না ছাড়ার যে দৃঢ় প্রত্যয় তা এখন আর আমাদের মাঝে নেই। তাই এখন কেউ কেউ নয় দিন অথবা কেউ কেউ নয় ঘন্টা আর বিশেষ করে যেসব মানুষ একটি পোস্ট ফেসবুকে একটি পোস্ট করার মাধ্যমেই নিজেদেরকে আন্দোলনের অংশীদার মনে করেন তারা সর্বোচ্চ নয় মিনিটে এসব মনে রাখেন।
হায়দার হুসেইন এর সেই গানটির কথা বারবার মনে পড়ছে। (যদিও আমরা এই গানটি খুব প্রয়োজনে হঠাৎ করে আবেগের দরজায় স্বল্পস্থায়ী বিবেক নাড়া দিলে শুনে থাকি) কি দেখার কথা কি দেখছি? কি শোনার কথা কি শুনছি? কি ভাবার কথা কি ভাবছি? কি বলার কথা কি বলছি?
তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি।
এই ধর্ষণ এর ক্রমাগত বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় যে কারণটা সেটি হচ্ছে সঠিক মূল্যবোধের অভাব এবং এর বিচারকার্যে সঠিক মূল্যায়ন এর অভাব। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কারণটি রাজনীতির ক্ষমতার নিচে চাপা পড়ে যায় তা হল পক্ষপাতিত্বমূলক বিচার। আমাদের দেশে এখনো সামাজিক কিছু বিচার ব্যবস্থা চালু রয়েছে যেখানে দেখা যায় স্বল্পশিক্ষিত চেয়ারম্যান অথবা ক্ষমতাধর ব্যক্তি বিচারের প্রধান বিচারক হিসেবে বিবেচিত হন এবং সে ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই, অধিকাংশ বিচারেই পক্ষপাতিত্ত মূলক আচরণ করা হয় নির্দিষ্ট স্থানের কিছু ব্যক্তির সম্মান রক্ষার্থে যেখানে ভুক্তভোগীর সম্মানের কথা খুব কম ক্ষেত্রেই ভাবা হয়।
এদেশে ধর্ষিতার পক্ষে সঠিক বিচার করার চেয়েও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষণের প্রমাণসমূহ নিরবে কৌশল বা ক্ষমতার ব্যবহারের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিয়ে ধর্ষককে রক্ষা করার মানুষের অভাব নেই তবে ধর্ষক যদি সাধারণ মানুষ হন তাহলে বিষয়টা ভিন্ন হয়। দ্বিতীয়ত যে কারণটি আমার চোখে ধরা পড়ে সেটি হচ্ছে মানুষের স্বল্পস্থায়ী প্রতিবাদী মনোভাব। এদেশে অপরাধমূলক ঘটনা এত নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি বিষয় সম্পর্কে আন্দোলন করে উঠতে না উঠতেই বা তার সমাধান হবার আগেই অন্য আরো কিছু ঘটনা ঘটে যায় এবং এই স্বল্পস্থায়ী আন্দোলনমুখী বাঙালি জাতি ক্রমাগত এক আন্দোলনের বিষয়ে হতে অন্য আন্দোলনের বিষয়ে স্থানান্তরিত হতে থাকে এবং নতুন ঘটনা জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে পুরনো ঘটনা সম্পূর্ণরূপে ভুলে যায়। আমরা ততদিন পর্যন্ত বিষয়টা কে আর মনে করার চেষ্টা করিনা যতক্ষণ পর্যন্ত মিডিয়া আমাদের সামনে সেটি আবার তুলে না ধরে। এককথায় যতক্ষণ পর্যন্ত যতদিন না পর্যন্ত দেশের মানুষের মধ্যে বিবেক জাগ্রত হবে এবং যতদিন না পর্যন্ত এদেশ ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার থেকে মুক্ত হবে না ততদিন পর্যন্ত এ ধর্ষণ থামবে না।
এই বিবেক জাগ্রত হতে যে পরিমাণ সময় দরকার সে পরিমাণ সময় আদৌ আমাদের হাতে আছে কিনা তা নিয়ে আমি সন্দেহ প্রকাশ করি। নারীদের সম্মান প্রদর্শনের বিষয়ে আমরা অন্তত যে ধরনের মনোভাব পোষণ করি তা বৃহৎ পর্যালোচনায় খুবই লজ্জাকর। এদেশের পুরুষসমাজ নিজের মা বোন এবং স্ত্রী ছাড়া বাকিদের প্রকৃতঅর্থে মন থেকে ততটা সম্মান করে থাকে না। কারণ ছোটবেলা থেকে যে পুরুষসমাজ নারীদের অন্তরের অথবা যোগ্যতাগত সৌন্দর্যকে বা ক্ষমতাকে পায়ে পিষ্ট করে তার তাদের দৈহিক সৌন্দর্য কে প্রাধান্য প্রদানপূর্বক তাদেরকে সবসময় পুরুষদের ব্যবহারের লক্ষ্যে সযত্নে আবৃত করে রাখার চেষ্টায় রত থাকেন, তারা বড় হয়েও তাদের মনের ভিতর পশুর মত মনোভাব হয়তো প্রত্যক্ষভাবে তা প্রকাশ করতে না পারলেও মনের মনে মনে তারা কোনভাবেই অন্য সকল নারীদের প্রতি ততটা সম্মান প্রদর্শন করতে রাজি নন। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। তাদেরকে সরাসরি দোষারোপ করা ও যাচ্ছে না। কারণ আমরা প্রতিটা মুহূর্তে নারীদেরকে পর্দাবৃত করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি যেখানে মানুষের চোখে এবং মনে পর্দা দেয়ার কথা কেউ বলছিনা। পৃথিবীতে মনের পর্দার চেয়ে শক্তিশালী পর্দা হতে পারেনা। ঠিক যেমনটা অনুভূতি আমরা আমাদের মা এবং আপন বোন এর জন্য পোষণ করি তা অন্যদের জন্য করতে পারলে আজ এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। এই মনের পর্দা শুধুমাত্র নিজের আচরণে নয় বরং নিজের অন্তরে ধারণ করাটাকেই প্রকৃত বিবেক বলে। যেদিন এই বিবেক জাগ্রত হবে সেদিন সমাজে কোন নারীকে আর নিজেদের খাঁচায় বন্দী করে রাখতে হবে না। অন্তত আশেপাশের পুরুষ গুলোর মধ্যে তারা তাদের ভাই এবং তাদের পিতাদের কে দেখতে পাবেন এবং আশ্বস্ত থাকবেন যে আশেপাশের মানুষগুলো অন্তত আর যাই হোক হিংস্র পশুর মত তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে না। সেদিনই একমাত্র নারীদের কাছে
এই সমাজ বনের শ্বাপদসংকুল পরিবেশ থেকে আলাদা হবে এবং নিরাপদ বলে বিবেচিত হবে।
সম্পাদক : ত্রৈমাসিক ঊষাবার্তা, বি.এ অনার্স , এম.এ, ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্য, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by syltech