হত্যা ও আত্মহত্যা : পারিবারিক কলহ ও আস্থার অভাবেই হচ্ছে এমন অপরাধ

প্রকাশিত: ৪:৫৮ অপরাহ্ণ, জুন ২০, ২০২১

হত্যা ও আত্মহত্যা : পারিবারিক কলহ ও আস্থার অভাবেই হচ্ছে এমন অপরাধ

আব্দুল খালিক

আজকাল জঘন্যতম অনেক অপরাধের মূলে দেখা যায় পারিবারিক কলহ। এক কথায় পরিবারের একের প্রতি অন্যের আস্থার অভাব থেকেই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। সেই সাথে রয়েছে অনৈতিক সম্পর্ক বা পরকিয়া। যার ফলে পরিবারের একের উপর থেকে অন্যের আস্থা-বিশ্বাস একদমই ওঠে যায়। কোনো কোনো পরিবারে আবার অভাব অনটনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে অভাব অনটনের কারণে নাকি পারিবারিক কলহের জেরে এসব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এছাড়াও রয়েছে জমি সংক্রান্ত বিরোধর জের। এ নিয়েও কম অপরাধ হয়নি। দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি নিয়ে বিরোধে হত্যা বা আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। বিশেষ করে পারিবারিক কলহ, আস্থাহীনতা ও জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণেই হত্যার মতো জঘন্যতম ঘটনা ঘটছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

 


তাদের মতে- উপরোক্ত কারণে পারিবারিক দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে, প্রেম-ভালোবাসা-আবেগ এসব লোপ পাচ্ছে। দাম্পত্য জীবনে আস্থা ও বিশ্বাস ওঠে যাচ্ছে। একে অপরকে সময় না দিয়ে হিংসাত্বক মনোভাব পোষন ও এক পর্যায়ে তা বিকারগ্রস্ততায় রূপ নিচ্ছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে বড় স্বার্থকে সামনে টেনে আনা হচ্ছে। সেই স্বার্থসিদ্ধি হাসিলে অনায়াসে একে অন্যকে হত্যা বা খুন করছেন, নয়তো নিজে আত্মহুতি দিচ্ছেন।

 


পরকিয়া প্রেমে অন্ধ হয়ে গত ১ মে সিলেটে আইনজীবী স্বামীকে হত্যা করেন শিপা বেগম। এরপর শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে ফোন করে স্বামী আনোয়ার হোসেনের মারা যাওয়ার খবর দিলে স্বাভাবিক মৃত্যুভেবে ওই দিন রাতেই পারিবারিক গোরস্থানে আনোয়ারের লাশ দাফন করা হয়। এর ১০ দিন পর কাওকে না জানিয়ে পরকিয়া প্রেমিক শাহজাহানকে বিয়ে করেন শিপা। এরপর থেকে নিহতের পরিবারের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করেন। পরে শিপার আচরণে সন্দেহ গাড় হলে আনোয়ারের ভাই মনোয়ার হোসেন হত্যা মামলা করেন। মামলায় স্ত্রী শিপা বেগম ছাড়াও আনোয়ারের শাশুড়ি রেশনা বেগম, শিপা বেগমের বর্তমান স্বামী শাহজাহান চৌধুরীসহ আটজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ওই মামলায় গ্রেপ্তার শিপা বেগম পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।

 


পরে সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের এমএম-২ দ্বিতীয় আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে পরকীয়া প্রেমে অন্ধ হয়ে নিজ স্বামীকে হত্যার কথা স্বীকার করে খুনের বর্ণনা দেন শিপা বেগম। গত ১৬ জুন (বুধবার) সিলেটের গোয়াইনঘাটে গৃহকর্তার হাতে খুন হন স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে। ওই তিনজনকে হত্যা করে তিনিও গুরুতর আহত হন। মূলত, তার আহত হওয়ার বিষয়টি ছিল অভিনয়। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে পুলিশ। ঘটনার দিনই গৃহকর্তা হিফজুরকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়। কারণ, হিফজুরের ঘরের বটি দা দিয়েই খুন করা হয়েছে। তারপর দা-টি পাতা দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছিল। হত্যাকান্ডের আগে বা পরে ওই ঘরে আর কেউ প্রবেশ করেনি। সেই থেকে হিফজুরকে সন্দেহ করে পুলিশ। বিষয়টি সামনে রেখে তদন্ত আগালে বেরিয়ে আসে একের পর এক রহস্য। অবশেষে বেশ কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে পুলিশ নিশ্চিত হয় যে, হিফজুর-ই ওই হত্যা কান্ড ঘটিয়েছেন। নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের তিনি কুপিয়ে হত্যা করেছেন। তবে, এর পেছনে পারিবারিক কলহ রয়েছে বলে দাবি করছে পুলিশ।

 


এদিকে ১৮ জুন (শুক্রবার) রাতের যেকোন সময় রাজধানীর ঢাকার কদমতলী থানায় বাবা-মা ও আপন বোনকে হত্যা করে মেহজাবিন। এরপর সে নিজেই ৯৯৯ কল করে বলে যে, আমি বাবা-মা ও বোনকে হত্যা করেছি। এবার স্বামী ও সন্তান কে খুন করবো। যদি দ্রুত আসতে পারেন, তাহলে এদের বাঁচানো যাবে নয়তো তাদেরও খুন করা হবে। পরদিন ১৯ জুন (শনিবার) পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় পুলিশ মেহজাবিনকে গ্রেপ্তার করলে সে জানিয়েছিল, পরিবারের সবার প্রতি ক্ষোভ থেকে প্রথমে সবাইকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে। এরপরই সকলের হাত-পা রশি দিয়ে বাঁধে। পরে গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। তার ছোট বোনের সাথে তার স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে বলেও সে উল্লেখ করে। মূলত, মানসিক বিকারগ্রস্ততা থেকে নিজের বাবা-মা ও বোনকে হত্যা করে মেহজাবিন।

 


সর্বশেষ ১৯ জুন (শনিবার) মধ্যরাতে সিলেটের ওসমানীনগর উপজেলার দয়ামীর ইউনিয়নের সোয়ারগাঁও এলাকার নিজ বাড়ির বদ্ধ ঘর থেকে শিক্ষিকা তপতীর গলাকাটা ও গৃহকর্মী গৌরাঙ্গ বৈদ্যের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তপতী রানী দে সোয়াইরগাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। তার স্বামী বিজয় দে পেশায় চিকিৎসক। তাদের দুই ছেলেমেয়েও চিকিৎসক। তপতী রানী দে সোয়াইরগাও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। তার স্বামী বিজয় দে পেশায় চিকিৎসক। তাদের দুই ছেলেমেয়েও চিকিৎসক। রোববার দুপুরে সিলেটের পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন বলেন, আমরা ধারণা করছি শিক্ষিকাকে বটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে নিজে গলায় গামছা পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে ঐ গৃহকর্মী। তিনি বলেন, তপতী রানী যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ির নিরাপত্তা ব্যাবস্থা খুবই শক্ত। ভেতর থেকে সকল দরজা ও ফটক তালা দেওয়াই ছিলো। ফলে বাইরে থেকে কেউ ভেতরে প্রবেশের কোনো আলামত পাইনি। ক্ষোভের বশে গৌরাঙ্গই তপতী রানীকে হত্যা করতে পারে। আপাতত এই ধারণা থেকেই তদন্ত এগোচ্ছি। তবে তদন্ত শেষে বিস্তারিত বলা যাবে।

 


এবিষয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডাক্তার মেখলা সরকার বলেন, ‘বিষয়টি এমন নয় যে, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক আগে ছিল না। তবে সম্প্রতি এটি প্রকাশ হচ্ছে বেশি। দাম্পত্য সম্পর্কে যখন কোনও সমস্যা হয়, তখন বিষয়টি জানাজানি হলে তা মানসিক চাপ বাড়ায়। অনেকেই তা সহ্য করতে পারেন না। তখনই ব্যক্তি হিতাহিত জ্ঞান হারায় ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটায়। আবার ক্রাইম সিরিয়ালগুলোও এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে উস্কানি দেয়।’

 


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেন, ‘সম্প্রতি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আস্থার অভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। এতে আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া দেখা যাচ্ছে স্বামী বিভিন্ন সময়ে কাজের কারণে বাইরে থাকছে। স্ত্রী বাসায় একা। একাকিত্বের সুযোগে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আবার একইভাবে দেখা যাচ্ছে স্বামীরাও জড়িয়ে পড়ছেন বিভিন্ন বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের দিকে। একটি পরিবার কিংবা দাম্পত্য পরিচালনা করতে যে মানসিক ও সামাজিক দক্ষতা উপলব্ধির প্রয়োজন, নিজেদের প্রস্তুত করার প্রয়োজন, ওই জায়গায় মোটা দাগে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।’

 


এসব অপরাধ দমনে দৃঢ় হোক পারিবারিক বন্ধন, বৃদ্ধিপাক দাম্পত্য জীবনের আস্থা ও বিশ্বাস। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সৃষ্টি হোক হৃদ্যিক সম্পর্কের মেলবন্ধন। তবেই, নির্মুল হবে হত্যা। শান্তি ফিরবে প্রতিটি পরিবারে।

 

লেখক : বার্তা সম্পাদক- দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ।

E-mail : abdul.khalik453@gmail.com

fb : abdul.khalik.900/facebook.com

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর