ঢাকা ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৫:৫৩ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩, ২০২১
লুৎফুর রহমান শাওন, ছাতক
ছাতকে নৌ পুলিশের উপর হামলা ঘটনায় দায়েরি মামলার প্রধান ৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাবের একটি বিশেষ টিম। সোমবার রাতে ঢাকা উত্তরা এলাকা থেকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাবের একটি বিশেষ টিম অভিযান চালিয়ে প্রধান আসামি আওয়ামী লীগ নেতা পৌর কাউন্সিলর তাপস চৌধুরীসহ এজহারভুক্ত ৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করে।
মঙ্গলবার গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন নৌ পুলিশের এসপি (সিলেট জোন) চম্পা ইয়ামিন।
গ্রেপ্তারকৃত আসামিরা হলেন- পৌর শহরের মন্ডলীভোগ কালিবাড়ি গ্রামে মৃত গোপিক রঞ্জন চৌধুরীর ছেলে পৌর কাউন্সিলর তাপস চৌধুরী(৪৫), বাগবাড়ি গ্রামে আব্দুল কাহার রঞ্জুর ছেলে সাদমান মাহমুদ সানি(৩০), কালারুকা ইউনিয়নের মুক্তিগাও গ্রামের উস্তার আলীর ছেলে বোমাকারক আলাউদ্দিন(৫১), ইসলামপুর ইউনিয়নের নোয়াগাও গ্রামে মৃত ফরিদ আহমদের ছেলে হাজি বুলবুল আহমদ (৪৬) ও পৌর শহরের বাগবাড়ি গ্রামে মৃত তেরা মিয়া চৌধুরীর ছেলে কুহিন চৌধুরী(৪১)।
এদিকে সোমবার বিকালে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তারকৃত ৫ আসামি নিয়ে র্যাব বাহিনী সিলেট উদ্যেশে রওয়ানা করেছে। সিলেট নৌ পুলিশ জোনের এসপির কাছে হস্তান্তর করার পরই সরাসরি সুনামগঞ্জ আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে নৌ পুলিশের পক্ষ থেকে বিজয়ের কণ্ঠকে জানানো হয়েছে।
এব্যাপারে নৌ পুলিশ ছাতক ফাড়ির ইনচার্জ রকিব আহমদ এ ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, সিলেট জোনের নৌ পুলিশের এসপি শম্পা ইয়ামিন এর সার্বিক সহযোগিতায় মামলার প্রধান আসামিদের র্যার বাহিনী আটক করে।
এ ব্যাপারে নৌ পুলিশের এসপি (সিলেট জোন) চম্পা ইয়ামিন গ্রেপ্তারের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, র্যাব উত্তরা-১ এর একটি অভিযানিক দল মামলার প্রধান আসামি ৫জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তাদেরকে সিলেটে নিয়ে আসা হচ্ছে। আমাদের কাছে হস্তান্তর করার পরই তাদের আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হবে।
জানা যায়, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলা নিয়ে চেলা ও মরা চেলা নদী বালুমহাল ৫শ ৬০ একর জায়গা নিয়ে অবস্থিত। এ নদীতে প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বালতি/ বেলচা দিয়ে বালু উত্তোলন করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। কিন্তু ১৪২৮ বাংলা সনের মহাল ইজারাদার মেসার্স ফয়েজ এন্টারপ্রাইজের পরিচালক ফয়েজ আহমদ ইজারার একাধিক শর্তভঙ্গ করে ছাতক, কোম্পানীগঞ্জ ও দোয়ারাবাজার এলাকার প্রভাবশালী ও অত্যাচারীদের হাতে বালুমহাল সাব-ইজারা দিয়েছে। এ সাব-ইজারাদাররাই বেআইনীভাবে ড্রেজারের পাশাপাশি শ্যালো ও বোমা মেশিন দিয়ে বালুমহালের ৫০-৬০ ফুট নিচ থেকে বালু উত্তোলন করেছে। গভীরতা বেড়ে যাওয়ার কারণে সনাতন পদ্ধতিতে বালু উত্তোলন করতে না পারায় এতে কর্ম হারিয়েছেন হাজারো শ্রমিকরা। নদী তীরের ৩ শতাধিক বাড়িঘর ও স্থাপনা এবং কয়েকশ’ একর ফসলি জমি ভাঙন হুমকিতে রয়েছে। অবৈধ ও নিয়মবহির্ভূত বালু উত্তোলনের কারণে নদী ভাঙনে দৌলতপুর গ্রামে একটি মসজিদ ও নাছিমপুর, শারপিননগর, রহিমের পাড়া, সোনাপুর, কাজিরগাও, পুর্ব লুভিয়া, চাইরগাও, রহমতপুরসহ ২০টি গ্রামের রাস্তা ঘাট,ঘরবাড়ি, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রায় ৩ শতাধিক বাড়িঘর নদী ভাঙন কবলে পড়েছে। ফকির টিলা থেকে সোনালী চেলা রাস্তা ও চারালবাড়ি এবং ক্যাম্পের বাজারে সরকারি রাস্তা ভেঙ্গে যাবার কারণে অর্ধলক্ষাধিক মানুষের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
শুধু তাই নয়, ইজারাদারে লোকজন নদীর ইজারাকৃত জায়গা ছাড়াও সৈয়দাবাদ, নিয়ামতপুর, এমদাদনগর, মাষ্টারবাড়িরসহ বন বিভাগের মুর্তা বাগান, ফসলি জমি থেকে শ্যালো ও বোমা মেশিন দিয়ে বালু ও পাথর উত্তোলন করেছে। এ কারণে পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু ইজারা চুক্তির ১২ নম্বার শর্ত লঙ্ঘন করে রাতভর অবৈধ বোমা মেশিন দিয়ে বালু ও পাথর উত্তোলন করলেও স্থানীয় প্রশাসন নিরব অবস্থানে রয়েছে বলে একতা বালু উত্তোলন ও সরবরাহকারী ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির দাবি করেন। একই সাথে চাঁদাবাজি ও টোকেন বাণিজ্যের বন্ধের দাবিতে দায়ের করা ওই রিট পিটিশন মামলার রিট সংযুক্ত করে নৌ-পুলিশে আবেদনও করেন।
গত ২০১৭ সালে ৩১ অক্টোবর ছাতক উপজেলা পরিষদ মিলনয়াতন তৎকালীন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাবিরুল ইসলাম সভা করে সুরমা ও চেলা নদীতে অবৈধ চাঁদা বন্ধে সরকারিভাবে রেজুলেশন করার পর নদী পথে চাদাবাজি বন্ধ হচ্ছে না। শ্রমিকরা অভিযোগ করে বলেন, ‘অবৈধভাবে ড্রেজার, বোমা ও শ্যালো মেশিন দিয়ে যান্ত্রিকভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনের ফলে যেমন প্রায় ১৫ হাজার শ্রমিক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বেকার হচ্ছেন, তেমনিভাবে পরিবেশও ধ্বংস হচ্ছে। এজন্য পরিবেশ বিধ্বংসী এ পন্থায় বালু উত্তোলন বন্ধ করে শ্রমিকদের জীবন জীবিকা সচল রাখার দাবি করেন।’
গত ৪ জুলাই সন্ধ্যায় অবৈধভাবে চেলা নদী শ্যলো ও বোমা মেশিন দিয়ে বালু ও পাথর উত্তোলনকালে বালু, পাথর বোঝাই নৌকা ও বোমা মেশিন আটক করার ঘটনায় ক্ষোব্ধ হয়ে দেশী অস্ত্র নিয়ে পৌর কাউন্সিলর তাপস চৌধুরী, বোমাকারক আলাউদ্দিন, হাজি বুলবুল আহমদ, কোহিনুর চৌধুরী, সাদমান মাহমুদ সানিও ইজারাদার ফয়েজ আহমদের নেতৃত্বে নৌ পুলিশের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ হামলার ঘটনা ঘটেছে উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের নিয়ামতপুর গ্রামের সামনে চেলা নদীতে। ঘটনাস্থল থেকে অবৈধভাবে বোমা মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন কালে আটককৃত বালু ভতি ৪দটি বাল্কহেড ৯টি বোমা মেশিন জব্ধ করার ঘটনায় বালুখেকো চত্রেুর মুলহোতা আ.লীগ নেতা পৌর কাউন্সিলর তাপস চৌধুরী, সাদমান মাহমুদ সানি বোমাকারক আলাউদ্দিন, হাজি বুলবুল, কোহিনুর চৌধুরী ও ইজারাদারদের নেতৃত্বে বেআইনী ভাবে জনতাবদ্ধে হয়ে নদীপথে নৌকা দিয়ে ঘেরাও করে নৌপুলিশের কমকতা কর্মচারিদের কর্তব্য কাজে বাধাঁ প্রদান ও পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্যেশে দেশীয় অস্ত্রসন্ত্র নিয়ে অতর্কিত হামলা চালিয়ে, ৪টি হাতকড়া, ১১টি মোবাইল, নগদ ৮০ হাজার টাকা লুটপাট ও মারপিট করে নৌ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ফাইল আটককৃত বালু ভর্তি ৪ টি বাল্কহেড ৯টি বোমা মেশিন জব্ধকৃত এসব মালামালগুলো লুটপাট করে নেন।
এ ঘটনায় নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মজুর আলমসহ ৮জন আহত হয়েছেন। স্থানীয়রা জনতা নদীর পানি থেকে নৌপুলিশকে আহত অবস্থায় তাদেরকে উদ্ধার করে ছাতক শহরের হাসপাতালে ভর্তি করেন।
এ ঘটনার খবর পেয়ে নৌ পুলিশের এসপি চম্পা ইয়ামিন ও সুনামগঞ্জ জেলার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বিপিএম আহতদের দেখতে ছাতক হাসপাতালে আসে। এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তারা বলেন, অপরাধী যে হোক তাদের কোনো ছাড় দেয়া হবে না। এ ঘটনার হামলাকারীদের গ্রেফতার এবং লুটকৃত মালামাল উদ্ধারের নির্দেশ দেন তারা ।
এ ঘটনার পর ও পৌর কাউন্সিলর তাপস চৌধুরী ও আলাউদ্দিনসহ একাধিক ব্যক্তি নাম উঠে আসে। এ ঘটনায় নৌ-পুলিশের এস আই হাবিবুর রহমান বাদী হয়ে পৌর কাউন্সিলর তাপস চৌধুরী প্রধান আসামি, দুই নম্বার সাদমান মাহমুদ সানি ও তিন নম্বার আলাউদ্দিনসহ মোট ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ২০১০ সালে ১৫(১) ধারায় (গত ৬ জুলাই ২১) একটি মামলা রুজ করেন থানায় (যার মামলা নং ৩৩/১৯৬)।
এঘটনার পর পাথর, বালুখেকো ও পরিবেশ বিধ্বংশী চত্রেুর মুলহোতা আওয়ামী লীগ নেতা পৌর কাউন্সিলর তাপস চৌধুরী, সাদমান মাহমুদ সানি, বোমাকারক আলাউদ্দিন, হাজি বুলবুল আহমদ, কুহিন চৌধুরী ও ইজারাদার ফয়েজ আহমদসহ হামলাকারিরা এলাকা ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় গিয়ে আত্মগোপন করায় সেখান থেকে ঢাকা উত্তরা র্যাব বাহিনী তাদেরকে আটক করতে সক্ষম হয়।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by syltech