আদর্শ শিক্ষক মাওলানা শাহ শফিকুল বারী (রহ.)

প্রকাশিত: ২:৪০ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৮, ২০২১

আদর্শ শিক্ষক মাওলানা শাহ শফিকুল বারী (রহ.)

রফিক আহমদ
হযরত শাহ্জালাল ইয়ামনী (রহঃ) এর স্মৃতি বিজড়িত জালালাবাদ সিলেট শহরের সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে অবস্থিত বরইকান্দি গ্রাম। সুরমার কুল ঘেষে শান্তস্নিগ্ধ পরিবেশে দাঁড়্িেয় আছে বরইকান্দি ইসলামীয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদরাসা। সিলেট বিভাগের শ্রেষ্ঠ মাদরাসা হিসাবে স্বীকৃতি প্রাপ্ত মাদরাসার পিছনে এক কীর্তিমান নিভৃত্তচারী পরিশ্রমী সাধক মানুষের চিরন্তর সাধনা জড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে বিন্দু বিন্দু করে গড়ে উঠেছে এ সুন্দর প্রতিষ্ঠান। এ গড়ে উঠার মাঝে আজো যেন সেই পরিশ্রমী কারিগরের ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়। শান্ত, সৌম্য, নির্লোভ, সৎ, পহরেজগার, স্বল্পভাষী, মিতব্যয়ী, ক্ষীণকায় এক আদর্শ মানুষ যিনি তাঁহার জীবন দিয়ে এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে শত শত শিক্ষার্থী তাঁর প্রতিষ্ঠানে পড়তে এসেছে। অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের নির্ভয়ে পড়তে পাঠিয়েছেন। অবশ্যই সেখানে সেই সাধকের ব্যক্তিত্বের একটা আকর্ষণ ছিল। এতক্ষণ যে সাধক পুরুষের কথা বলে ছিলাম তিনি হচ্ছেন মাওলানা শফিকুল বারী (রহ.)। সম্প্রতিক তাঁর মৃত্যু দিবস। জগতে তাঁর কাজকর্ম যেমনটা নীরবে সারতেন, ঠিক তেমনি নীরবে চলে যায় তাঁর মৃত্যু দিবস।

 

পরিচিতি :
নাম: মাওলানা শাহ শফিকুল বারী (রহঃ)
জন্ম: সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার ইউনিয়নের সতীঘর গ্রামের এক মুসলিম সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১জুলাই ১৯৩৫ ঈসায়ী তারিখে জন্ম গ্রহণ করেন।
বংশ পরিচয়: পিতা মৌলভী শাহ্ আব্দুল লতিফ মুন্সি (রহ.) একজন ধর্মপ্রাণ ভদ্র সম্মানিত ব্যক্তি হিসাবে অত্র অঞ্চলে তাঁর খ্যাতি রয়েছে। পাকিস্তান শাসন আমলে তিনি মোগলাবাজার এলাকার সরপঞ্চ ছিলেন। দাদা শাহ্ শরফ উদ্দীন, পিতামহ শাহ্ নজমুদ্দীন, দাদামহ শেখ রহমত ১৭৯৩ ইংরেজী লর্ড কর্নওয়ালিশ থেকে তৌজী নং-৩৭৯১৪/১৮৪ তাল্লুক বন্দোবস্ত। মাতা তহুরুন নেছা, নানা মৌলভী শাহ্ আর্শদ আলী মুন্সি (রহ.), অপর নানা শাহ্ মোহাম্মদ এহিয়া (রহ.) একজন পীরে কামেল ছিলেন। তাঁহার মুরিদাগণ আজও সিলেট, বৃহত্তর কুমিল্লা, ময়মনসিংহ-সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছেন। উল্লেখ্য যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সংসদ সদস্য মরহুম পীর হবিবুর রহমান সাহেব পীরে কামেল শাহ্ মোহাম্মদ এহিয়া (রহ.)-এর ছেলে। সুতরাং মায়ের বংশ সূত্রে মরহুম মাওলানা শফিকুল বারী (রহ.)- এর মামা মরহুম পীর হবিবুর রহমান। বিভিন্ন তত্বে দেখা যায় পীর মোহাম্মদ এহিয়া (রহ.) ছিলেন ইয়ামেনের অধিবাসী।

 

শিক্ষা গ্রহণ :
প্রাথমিক শিক্ষা: তিনি নিজ পিতার তত্ত্বাবধানে সতীঘর গ্রামে নিজ বাড়িতে সাবাহী মক্তবে লেখা পড়া করেন। তৎকালিন সময় অত্র এলাকার কয়েকটি গ্রামের মানুষ তাঁর পিতা মৌলভী শাহ্ আব্দুল লতিফ মুন্সি (রহ.) নিকট দ্বীনিয়াত শিক্ষা অর্জনের জন্য বাড়িতে আসতেন।

 

 

মাধ্যমিক শিক্ষা: স্থানীয় স্কুলে কিছু দিন লেখা পড়ার পর দ্বীনি শিক্ষা অর্জনের জন্য হযরত বদরুল আলম শায়খে রেঙ্গা (রহ.)-এর তত্ত্ববধানে প্রতিষ্ঠিত দ্বীনি বিদ্যাপিঠ জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙ্গা মাদরাসায় ভর্তী হয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন।

 

উচ্চ শিক্ষা: সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা থেকে ১৯৫৮ সালে আলিম এবং ১৯৬৪ সালে ফাজিল পরীক্ষায় সুনামের সাথে উত্তীর্ণ হন। মরহুম শফিকুল বারী অত্যান্ত জ্ঞান পিপাসু ছিলেন। তিনি দ্বীনি বিষয়ে আর জ্ঞান অর্জনের জন্য চলে যান বৃহত্তর সিলেটের অন্যতম দ্বীনি বিদ্যাপীঠ সৎপুর আলিয়া মাদরাসায়। সেখানে হযরত মাওলানা গোলাম হোসেন সাহেবের তত্ত্বাবধানে ১৯৬৭ সালে কৃতিত্বের সাথে কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

 

সম্মানীত উস্তাদবৃন্দ: সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসায় অধ্যায়নকালে যে সকল শ্রদ্ধাভাজন উস্তাদগণের সংস্পর্শ ও সুহবতে দ্বীনি জ্ঞান অর্জন করেন তাদের মধ্যে শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা আব্দুল বারী (মোগলাবাজার), হযরত মাওলানা আব্দুল ওয়াহিদ (রাজারগাঁও), হযরত মাওলানা আব্দুল হক (জিঙ্গাবাড়ি), হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ (জালালপুর), হযরত মাওলানা ফজলে হক কাহিল (গাছবাড়ী), হযরত মাওলানা ইয়াকুব শরীফ (নোয়াখালি), হযরত মাওলানা আহমদ হাসান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), হযরত মাওলানা লুৎফুল হক (গহরপুর) অন্যতম।

 

সুযোগ্য সাথীবর্গ: তাঁর সাথীবর্গের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য কয়েক জন হলেন- হযরত মাওলানা মুফতি আলাউদ্দীন (যুক্তরাজ্য প্রবাসী), হযরত মাওলানা আব্দুর রহিম (যুক্তরাজ্য প্রবাসী), হযরত মাওলানা আব্দুল হক (লক্ষীপাশী), হযরত মাওলানা মঈনুল হক (সুনামগঞ্জী), হযরত মাওলানা আব্দুস সালাম (হবিগঞ্জী), হাফিজ মাওলানা সিরাজ উদ্দীন (গাছবাড়ি), হযরত মাওলানা নুরুজ্জামান (সুনামগঞ্জী), হযরত মাওলানা আলী আহমেদ (হবিগঞ্জী), হযরত মাওলানা আব্দুল মান্নান (হবিগঞ্জী), হযরত মাওলানা আব্দুর রউফ (হবিগঞ্জী)। এদের মধ্যে অনেক দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। আল্লাহ পাক তাদের জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন, আ-মিন।

 

বিবাহ: মরহুম মাওলানা শফিকুল বারী ভারত উপমহাদেশের অন্যতম পীরে কামেল মাওলানা হাফিজ আহমদ জৌনপুরী (রহ.)-এর তৃতীয় খলিফা হযরত মাওলানা শাহ্ মোঃ সৈয়দুল আমীন (পাথারিয়ার পীর)-এর চতুর্থ কন্যা আমিনা খাতুন-এর সাথে ১৫ই অক্টোবর ১৯৬৭ ঈসায়ী তারিখে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পারিবারিক জীবন শুরু করেন। তিনি তিন ছেলে ও তিন মেয়ে সন্তানের জনক ছিলেন।

 

তাসাউফ গ্রহণ: তিনি বিশ্বের অন্যতম আলেম হযরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্ল্যাহ হাফেজ্জী হুজুরের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে তাসাউফ শিক্ষা গ্রহণ করেন। হযরত হাফেজ্জী হুজুরের ইন্তেকালের পর তাঁর অন্যতম খলিফা হযরত মাওলানা ক্বারী শফিকুল হক চৌধুরী সাহেব-এর কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেন।

 

কর্মজীবন: ১৯৬৯ ঈসায়ী বরইকান্দি ইসলামীয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং প্রতিষ্ঠাতা সুপার হিসাবে ০৮/০৩/১৯৬৯ ঈসায়ী তারিখে মাত্র ৬০/- টাকা মাসিক বেতনে যোগদান করেন। মাদরাসায় যোগদানের পর তিনি কঠিন বাস্তবতার সম্মূখীন। সে সময় মাদরাসার শিক্ষার অবস্থা ছিল খুবই করুন, মাদরাসার শিক্ষার প্রতি মানুষের আকর্ষন স্কুলের তুলনায় ছিল অনেক কম। সে কারনে মাদরাসার ছাত্র সংগ্রহ করা ছিল খুবই কষ্ট সাধ্য। তাই ছাত্র সংগ্রহের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝাতেন। আর এভাবেই মাত্র ১৩ জন ছাত্র নিয়ে বরইকান্দি মাদরাসার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। অনেক সমস্যা ও প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে এলাকাবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতায় মাদরাসার কাজ পুরোধমে চালিয়ে যেতে থাকেন। ফজরের নামাজ পড়েই বেশির ভাগ সময় বের হয়ে পড়তেন মাদরাসার কাজে। ক্লাস শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মাদরাসার সমস্যা সমাধানের জন্য কমিটির লোকজন সহ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাড়িতে ছুটে যেতেন বার বার। প্রয়োজনে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে হলেও দেখা করে আসতেন। এতে মোটেই বিরক্ত হতেন না।

 

ইমামতির দায়িত্ব পালন: তিনি সিলেট শহরের প্রাণকেন্দ্র তোপখানায় অবস্থিত সিএমবি মসজিদ প্রতিষ্ঠাতা করে দীর্ঘ দিন ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন।

 

মতবিরোধ এড়িয়ে চলা: মাওলানা সাহেব ছিলেন সদালাপী অতি সজ্জল ও সত্যিকারের ভদ্র লোক। উনার কথা বলার টেকনিক ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। আগ্রহভরে সকলেই উনার কথা শুনতো। তিনি সব সময় বিরোধকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। অতি সৎ ন্যায় পরায়ন, সাধারণের মধ্যে অসাধারণ ব্যক্তি ছিলেন মাওলানা সাহেব। শফিকুল বারীর দীর্ঘ কর্ম জীবনে তিনি কার সাথে কোনরূপ রাগারাগি, কথা কাটাকাটি, মতানৈক্য করতেন না। মাদরাসার সমস্যা তিনি অকপটে কমিটিকে বলতেন এবং সবাই মিলে এর বাস্তব সমাধান করতেন। যে কারণে মাদরাসা কমিটিতে কোন বিরোধ ছিল না। এমনকি শিক্ষকদের মধ্যেও কোন দলাদলি বা রেশারেশি ছিল না। মাদরাসায় সব প্রকার রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। কোন প্রকার রাজনৈতিক লক্ষণ দেখলে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তখন তাঁকে কঠোর মনে হত। বরইকান্দি ইসলামীয়া মাদরাসার উন্নয়নে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার প্রতি মাওলানা সাহেবের সজাগ দৃষ্টি ছিল।

 

শিক্ষকদের সাথে আচরণ: মাদরাসার একজন দায়িত্বশীল হিসাবে তিনি নিয়মনীতির প্রতি ছিলেন বড়ই কঠোর। রাজনীতি ও দলাদলি মুক্ত শিক্ষাঙ্গন তৈরীতে তিনি ছিলেন খুবই যত্নশীল। সে জন্য শিক্ষকদের-কে সব ধরনের দলাদলি ও রাজনীতি মুক্ত থেকে ছাত্রদের শিক্ষাদানের প্রতি যত্নশীল হওয়ার জন্য সর্বদা পরামর্শ দিতেন। কিন্তু এর ব্যতিক্রম হলে প্রয়োজনে শোকজ নোটিশ করতেও মোটেই দ্বিধাবোধ করতেন না। শিক্ষকদেরকে মনোযোগ সহকারে ক্লাস নিতে দেখলে খুবই খুশি হতেন অন্যতায় বিরক্তি প্রকাশ করতেন। মাদরাসা ছুটির পরও শিক্ষকদেরকে শিক্ষাদানে বা মাদরাসার কাজে ব্যস্ত দেখলে খুশি হতেন। মুচকি হেসে কাছে গিয়ে প্রশংসা করতেন। প্রয়োজনে আরও উৎসাহ যোগাতেন। মাদরাসার বিভিন্ন কাজে সহযোগীতা ও পরামর্শ নেওয়ার দরকার হলে তিনি শিক্ষকদের বাড়িতে বা লজিংয়ে নিঃসংকোচে দিন রাত যে কোন সময় উপস্থিত হতেন। প্রয়োজনীয় কথাবার্তা শেষ হলে নাস্তা খাওয়ার অনুরোধ করলে তিনি না করতেন। কারো বাড়ীতে পারত পক্ষে কিছু খেতে চাইতেন না। এভাবে সারাটি সকাল গ্রাম ঘুরে মাদরাসায় গিয়ে চিড়া ভিজিয়ে খেতেন। খাবারের প্রতি উদাসীনতার কারনে তিনি শারীরিক ভাবে দূর্বল হয়ে এক সময়ে রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁহার অকাল মৃত্যু হয়ত অন্যতম কারণ।

 

ছাত্রদের সাথে আচরণ: ছাত্রদের প্রতি তিনি ছিলেন খুবই স্নেহশীল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে গেলে ছাত্ররা সহজে সেটা উপলব্দি করতে পারত না। সর্বদা গম্ভীর থাকতেন বলে ছাত্ররা তাকে একটু বেশি ভয় পেত। সহজে কেউ কাছে যেত না। প্রয়োজনে অন্য শিক্ষকদের স্মরণাপন্ন হত। ছাত্রদের সর্বদা লেখাপড়া করতে উৎসাহ দিতেন এবং দলাদলি ও রাজনীতি থেকে মুক্ত থাকতে কঠোর নির্দেশ জারী করতেন। কাউকে নেতাগিরী করতে প্রশ্রয় দিতেন না। শুরু থেকেই এলাকাবাসীর সার্বিক সহযোগিতা নিয়ে দলাদলি ও রাজনীতি মুক্ত শিক্ষাঙ্গন গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করলে সে ধারা আজও অব্যাহত আছে। ছাত্ররা যাতে ভাল ফলাফল অর্জন করতে পারে সেজন্য ভাল শিক্ষক নিয়োগ দানে তিনি খুবই আন্তরিক ছিলেন। বৃত্তি ও ফাইনাল পরীক্ষা সমূহে ছাত্ররা ভাল ফলাফল অর্জন করতে পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষকদের সর্বদা পরামর্শ দিতেন। বিশেষ করে নির্বাচনী পরীক্ষায় তিনি খুবই কড়াকড়ি করতেন। অকৃতকার্য ছাত্রদের জন্য কোন প্রকার সুপারিশ গ্রহন করতেন না। একবার নির্বাচনী পরীক্ষায় অকৃতকার্য এক ছাত্রকে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য জনৈক ব্যক্তির কাছ থেকে অনুরোধ আসলে তিনি তা বিনয়ের সাথে ফিরিয়ে দেন। আবারও অনুরোধ আসলে তিনি পরিস্কার ভাষায় জানিয়ে দিলেন প্রয়োজনে দায়িত্ব থেকে রিজাইন দিবেন তবুও নীতি ছাড়বেন না। শুধু প্রশাসন নয়, ছাত্রদের পড়াশোনা ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের প্রতি উনার সজাগ দৃষ্টি ছিল। এর ফলে মাদরাসার ছাত্ররা প্রতি বছর উপজেলা, জেলা, ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিজেদের স্থান করে নিত। কর্ম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শিকক্ষবৃন্দ তাঁকে এ নীতির উপর অটল থাকতে দেখেছেন।

 

কর্মজীবনে সাফল্য অর্জন: বরইকান্দি মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা সুপার হিসাবে শুরু হয় মাওলানা সাহেবের কর্ম জীবন। তাঁর যাত্রা পথ ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ও সমস্যায় জর্জরিত। কিন্ত শত প্রতিকূলতা, বহুমূখি সমস্যা ও মাদরাসার আর্থিক সংকটেও হাল ছাড়েননি। চরম ধৈর্য্যপূর্ণ আন্তরিকতা ও নিরলস কর্মনিষ্ঠার মাধ্যমে এলাকাবাসী ও প্রবাসী দানশীলদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে দ্বীনি শিক্ষা চালিয়ে যান পুরোদমে। এভাবে সুদীর্ঘ ২৬ বছর খেদমত করে বরইকান্দি মাদরাসাকে দেশের অন্যতম একটি দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সক্ষম হন। আর তাঁর সেই অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণকালে আরও দুই বছর কর্মরত থাকার জন্য ম্যানেজিং কমিটি ও তৎকালিন থানা নির্বাহী কর্মকর্তা (টিএনও)-এর পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু এ লোভনীয় প্রস্তাব তিনি গ্রহণ করেননি। এলাকাবাসীর কাছে তিনি একজন সৎ নীতিবান সুপার হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন।

 

আমানতদারী: মাওলানা শফিকুল বারী কর্মজীবনে ছিলেন অত্যান্ত সৎ ও আমানতদার। সুদীর্ঘ ২৬ বছর একাধারে সুপার হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে দেশ-বিদেশ থেকে মাদরাসার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা এসেছে তাঁহার হাতে। সাথে সাথে তিনি বিধি মোতাবেক জমা রাখতেন এবং সেই সাথে ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকবৃন্দকে অবগত করতেন। আর্থিক লেনদেনে তিনি ছিলেন খুবই সচেতন ও সৎ। মাদরাসার একটি টাকাও তাঁর হাতে কখনও খেয়ানত হয় নাই। সরকারি ও বেসরকারি অডিটেও তাঁর আমানতদারী সর্বদা প্রমাণিত হয়েছে।

 

অবসর গ্রহণের পর হিসাব রক্ষক হিসাব করে দেখেন তিনি মাদরাসার কাছে টাকা পান। পরে শিক্ষা সচিব জনাব আব্দুল কুদ্দুস-এর মাধ্যমে ঐ টাকাগুলো তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

 

অতিথি পরায়ণ: মাওলানা শফিকুল বারী সাহেব ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন অতিথি পরায়ন। তিনি আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশির খোজ খবর রাখতেন। মাদরাসার সহকারী শিক্ষক খন্দকার শরফ উদ্দীন আহমদ মামুন সাহেব স্মৃতি চারন করতে গিয়ে বলেন তাঁর বড় মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে তিনি যার পর নাই খুশি হন এবং আত্মীয় স্বজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। খাবারের সময় খুব বেশি খোঁজ খবর নিয়েছেন। অনুষ্ঠান শেষে বিদায় নিতে গেলে বিদায় নিতে রাজি হননি। চা পান করে যাওয়ার অনুরোধ করেন এর ফাকে তাঁকে সাথে নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাড়ির সীমানা, পুকুর ও গাছপালা দেখান। অনেক সুখ দুঃখের কথাও শুনালেন। মনে হয়েছে আমি যেন তাঁহার আত্মার আত্মীয়। এভাবে আন্তরিক পরিবেশে অনেক্ষণ খোশ গল্পে সময় কাটালেন পরম আনন্দে। পরিশেষে বিদায় বেলায় বাড়ি থেকে বের হয়ে অনেক দূর পর্যন্ত তাহাকে এগিয়ে দেন।

 

অনাড়ম্বর জীবন যাপন: মাওলানা শফিকুল বারী সাহেব সাদাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তাঁর চালচলন কথাবার্তা পোশাক পরিচ্ছেদে ছিলনা কৃত্রিমতা। সব কিছুতেই পরিলক্ষিত হত প্রচার বিমূখতা। প্রচার বিমূখ জীবনকে তিনি খুবই পছন্দ করতেন। তার জীবন্ত প্রমাণ তাঁর অবসর গ্রহনকালীন সময়ে। সূদীর্ঘ ২৬ বছর সফল ভাবে দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়ে নিরবে বিদায় নিলেন প্রতিষ্ঠান থেকে। মাদরাসার শিক্ষক মন্ডলী, ম্যানেজিং কমিটি ও এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বিদায় সম্বর্ধনা দেওয়ার শত অনুরোধ করা সত্বেও তিনি তাতে রাজি হননি। অনাড়ম্বর ও প্রচার বিমূখ জীবনই ছিল তাঁহার একান্ত কাম্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেটাই সহকর্মী ও শুভাখাঙ্কীগণ প্রত্যক্ষ করেছে গভীরভাবে। বর্তমান যুগে এরূপ নির্লোভ সৎ মানুষের সংখ্যা সত্যিই নগণ্য।

 

ইন্তেকাল: শিক্ষার্থীদের শ্রদ্ধাভাজন ও প্রিয় নিরহংকার খোশ মেজাজের এ শিক্ষক রোগে শোকে এক সময় কাতর হয়ে পড়েন। স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে তাঁকে সিলেট শহরের উপশম ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। উক্ত ক্লিনিকেই তিনি ০৬/০৮/১৯৯৮ ঈসায়ী তারিখে রোজ বৃহস্পতিবার সকাল ছয় ঘটিকায় ৬৩ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

 

দাফন কাফন: মরহুম মাওলানা শফিকুল বারী (রহ.) ইচ্ছা ছিল তাঁর জানাজার নামাজ বড় ছেলে মাওলানা শাহ্ মিজানুল হক পড়াবেন। কিন্তু তিনি যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের কারনে তাঁর ওয়াসিয়ত অনুযায়ী মোগলাবাজার জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফিজ মাওলানা ফখরুল ইসলাম-এর ইমামতিতে জানাজার নামাজ আদায় করা হয়। সতীঘর জামে মসজিদের নিকটে তাঁর পারিবারিক গোরস্তানে পিতা মাতার কবরের পার্শ্বে দাফন করা হয়।

 

পরিশেষে অত্র মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক ও তাঁর প্রিয়ভাজন খন্দকার শরফ উদ্দীন মামুন কর্তৃক তাঁর শানে রচিত কবিতার মাধ্যমে মরহুমে মাগফেরাত কামনা করছি।

 

“আল্লাহু, আল্লাহু, আল্লাহু আল্লাহ!/ উসতাজুল মোকাররাম সুপার শফিকুল বারী/ চলে গেলেন হায় মোদের সবারে ছাড়ি। রবিউস সানির ১২তারিখ সকাল বেলায়/ দুনিয়া থেকে তিনি নিলেন চির বিদায়। প্রতিষ্ঠাতা সুপার যিনি এই মাদরাসার/ আজ তাঁরই বিরহে হৃদয় কাঁদে সবার। জীবন দিয়ে গড়লেন এ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান/ যুগে যুগে শিক্ষা দিবে হাদীস কোরআন। এ গুলবাগে নব্বীর দুর্দিনের কান্ডারী/ মহান সাধক মাওলানা শফিকুল বারী। তাঁরই সাধনায় মাদরাসা আজ উজালা/ কবুল করে নাও ওগো আল্লাহ তায়ালা। দু’হাত তুলে সবাই মিলে করি মোনাজাত/ সুপার সাহেব-কে খোদা দান কর নাজাত। রহমতের বারিষে রুহের বাড়িয়ে জৌলুস/ তাঁকে দান কর আল্লাহ জান্নাতুল ফেরদাউস।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর