ঢাকা ১লা এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:৪৭ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৪, ২০২১
বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল
সিলেটের বিশিষ্ট লেখিকা কবি ও সংগঠক লাভলী চৌধুরী আর নেই। শনিবার (৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ খ্রি.) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তিনি দুই ছেলে, নাতি-নাতনীসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। মরহুমার জানাজা আজ বাদ এশা হজরত শাহজালাল (রহ.) মাজার প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি এবং শোকাহত পরিবার-পরিজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই। আল্লাহ তায়া’লা তাঁকে ক্ষমা করে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন। আমিন।
উল্লেখ্য, কবি লাভলী চৌধুরী একজন নিভৃতচারী কথাশিল্পী ছিলেন। সত্য ইতিহাস, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ আর প্রবল স্মৃতিকাতরতায় ভরপুর তাঁর লেখাগুলো পাঠককে মোহিত করে ঠিক যেন নদীর স্রোতের মতো প্রবহমান। তিনি একজন সৃজনশীল লেখিকা এবং সিলেটের লেখিকাদের মধ্যে ছিলেন অগ্রসরমান। তাঁর সাহিত্যকর্ম কোনো বলয় বা পরিমণ্ডলে বেষ্টিত ছিলো না। তাঁর লেখাগুলো নানা ধরনের প্রাচুর্যে ভরা সুবাস বিলাসী ছিল। সৃষ্টিশীলতার সৌন্দর্যে লাভলী চৌধুরী একজন সৌন্দর্যের কবি। নিঃসন্দেহে তিনি একজন আধুনিক মানসের পরিচায়ক। মূলত কবি হলেও তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তাঁর বিচরণ ছিল লক্ষণীয়। দীর্ঘ সময়ের সাধনা ও পরিশ্রমে বাংলাসাহিত্যে নিজেকে আলাদা পরিচয়ে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
বরেণ্য এ লেখিকার জন্ম ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে (২৫ বৈশাখ)। পৈতৃক নিবাস সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার সিকন্দরপুর। তাঁর বাবা শিক্ষাবিদ মরহুম লতিফুর রহমান চৌধুরী ও মা সিতারা বেগমও ছিলেন একজন লেখিকা, সমাজ সংস্কারক। তাঁর আরো একটা বড় পরিচয় ছিল, তিনি এদেশের লোকসাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মরহুম আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্নের মেয়ে পক্ষের নাতনি। লাভলী চৌধুরী ছয়-এর দশকের জনপ্রিয় কবি ও কথাশিল্পী ছিলেন। তিনি তাঁর সৃজনশীলতার মাধ্যমে উভয় বাংলায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছেন। সাহিত্যের মধ্যে তাঁর কর্ম স্বাক্ষর হিসেবে আমরা দেখতে পাই-১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘শিখা’ নামে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেন। আর এর ভেতর দিয়েই সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন। সাহিত্যের কাগজ এই ‘শিখাটি’ অনেক সময় পযন্ত আভা ছড়িয়েছিল। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা সতেরোটি এবং যৌথ গ্রন্থের সংখ্যা আটটি। তিনি বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার ও নাট্যকার ছিলেন। স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে একসময় তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল।
কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য তিনি অনেকগুলো জাতীয়, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা লাভ করেছেন। তন্মধ্যে নারী গ্রন্থ ও প্রবর্তনা (১৯৯৯ খ্রি.), শেকড়ের সন্ধানে অ্যাওয়ার্ড (১৯৯৯ খ্রি.), স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্মাননা (২০০৩ খ্রি.), আশরাফ সিদ্দিকী ফাউন্ডেশন, ঢাকা (২০০০ খ্রি.), মৌলানা ইয়াসীন শাহ (রহ.) এ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ (২০০১ খ্রি.), বেগম সাজিদুন্নেসা খাতুন চৌধুরী রাজী, বাংলা ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, ঢাকা (২০০৬ খ্রি.), জাতীয় সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, ঢাকা, কালচারাল ফাউন্ডেশন, সিলেট (২০০৮), অতন্দ্রপদক (ঢালিগঞ্জ অতন্দ্র সাংস্কৃতিক সংসদ), কলকাতা, ভারত (২০১২ খ্রি.), রাগীব-রাবেয়া একুশে সম্মাননা পদক (২০১০ খ্রি.), বাংলাদেশ কবিতা সংসদ পাবনা (১৪০৮ বঙ্গাব্দ), ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা বিভাগ (২০১১ খ্রি.), নন্দিনী সাহিত্য পাঠচক্র-সাহিত্য পদক (২০০৫ খ্রি.), গঙানন্দিনী, কলিকাতা, বরেন্দ্র নন্দিনী-রাজশাহী, রোটারী ক্লাব অব সিলেট সুরমা, রোটারী ক্লাব অব মেট্রোপলিটন, লায়ন্স প্রেসিডেন্ট এ্যাওয়ার্ড প্রভৃতি। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও গুণগত মানে তাঁর সৃষ্টিসম্ভার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে আছে-গীতিগুচ্ছ, এই গ্রন্থটিতে সংকলিত হয়েছে তাঁর হৃদয়ের সুর; প্রেম-বিচ্ছেদের গতিময় অনুরণন। কবিতার বইয়ের মধ্যে আছে-পুষ্পিতা,আনন্দ কারাগার, যখন একা বসে থাকি, তোড়া ইত্যাদি।
এছাড়া ছোটদের জন্য তাঁর বইগুলো হচ্ছে-ইমু ও পাগলা হাতি, গল্পে ছড়ায় ইরাম। ছোটগল্প : ‘আকাশ প্রদীপ।’ ‘গবেষণা’ : তিরিশ বছর পর, মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ও তাঁর গীতি । জীবনী : ‘উম্মাহাতুল মুমিনা রাসুল (সা.)’-এর জীবন সঙ্গিনীদের পরিচিতি। সম্পাদনা : ‘অনিয়মিত সাহিত্যপত্র শিখা ও অন্যান্য।’ চলচিত্র কাহিনি : ‘কলঙ্কিত চাঁদ (করিমুনন্নেসা)।’
কবি লাভলী চৌধুরী আমার একজন বিশ্বস্ত অভিভাবক ছিলেন। তাঁর সাথে আমার ভাইবোনের সম্পর্ক থাকলেও বয়সের দিক থেকে আমি তাঁর কাছে ছিলাম সন্তানতুল্য। তিনি আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করতেন। তাঁর সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে নানাভাবে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। কয়েকবার তাঁর সাথে পরিবারিকভাবে দেশ-বিদেশ সফর করেছি। বিশেষ করে, ভারতের শিলং, শিলচর এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার সেন্টমার্টিনসহ আরো অনেক জায়গায়। দীর্ঘযাত্রা পথে তাঁর কাছে জীবন-জগত এবং সাহিত্যের নানাদিক বিষয় নিয়ে অনেক মূল্যবান আলাপচারিতা করেছি। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং সামাজিক নানা বিষয়ে তিনি আমাকে সুন্দর পরামর্শ দিতেন। তাঁর মৃত্যুতে আমি আমার এক মমতাময়ী অভিভাবককে হারালাম।
মৃত্যু জীবনের সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা। একে উপেক্ষা করার শক্তি কারো নেই। পৃথিবীতে মানুষ আসে মরণকে বরণ করার জন্য। তবে কিছু মানুষ তাঁর মৃত্যুতেও রেখে যায় তাঁর অমর কর্মের স্বাক্ষর। মৃত্যুই তাঁর স্মরণের পথকে উন্মুক্ত করে দেয়। কবি লাভলী চৌধুরী ছিলেন সেই ধরনের একজন মহিয়সী নারী। তিনি তাঁর চিন্তাচেতনা এবং সাহিত্যসাধনাকে সেই মহান উদ্দেশ্যেই নিবেদিত করেছেন। এজন্য ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি ছিলেন একজন খোদাভীরু নারী। আতিথেয়তা এবং আন্তরিকতায় তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। পারিবারিক কাজের বাইরেও তিনি মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াতেন। তাঁর মতো মহিয়সী নারীর মৃত্যুতে সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে এক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি তাঁর কর্মের মাধ্যমে সকলের মাঝে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে থাকবেন।
লেখক, প্রকাশক ও সংগঠক।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by syltech