পুলিশ মেমোরিয়াল ডে-২০২৩

প্রকাশিত: ১২:৫৪ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১, ২০২৩

পুলিশ মেমোরিয়াল ডে-২০২৩

মো. জেদান আল মুসা

পুলিশ সুপার,

রেঞ্জ ডিআইজি’র কার্যালয়, সিলেট।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বছরের একটি নির্দিষ্ট দিনে কর্তব্যরত অবস্থায় নিহত পুশি সদস্যদের কৃতিত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানকে স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশ পুলিশ ২০১৭ সলের ১লা মার্চ থেকে কর্তব্যরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী পুলিশ সদস্যদের স্মরণে “পুলিশ মেমোরিয়াল ডে” পালন করে আসছে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকাসহ সকল রেঞ্জ ও জেলা পর্যায়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

 

দেশের অভ্যন্তরীন নিরপত্তা বিধান, আইন-শৃংঙ্খলা ও জনগণের জান-মাল রক্ষার মত ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকে পুলিশ সদস্যরা। দেশের যে কোন প্রয়োজন ও সংকটে নিজের জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেন না তাঁরা। কর্তব্য পালনকালে প্রতি বছর অনেক পুলিশ সদস্য আহত ও নিহত হন। তাঁদের আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত পুলিশ বাহিনীর জন্য গৌরব ও সম্মানের।

 

জাতীয় যেকোন সংকটে সামনে থেকে দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ পুলিশ। মহামারি করোনা কালীন নিজেদের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসুস্থ করোনা রোগীদের হাসপাতালে নেওয়া, সেবা শুশ্রূষা করা, খাদ্য বিতরন, ওষুধ পৌছিয়ে দেওয়া, অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস ইত্যাদি কাজও করেছেন এ বাহিনীর সদস্যরা। অনেক ক্ষেত্রে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির স্বজনরা দূরে সরে গেলে দাফনের কাজও পুলিশ করেছে।
সম্প্রতি সিলেট অঞ্চলের মানুষ বিগত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে। ২০২২ সালের এই ভয়াবহ বন্যায় বাড়িঘর, ফসলি জমি, গবাদি পশুসহ যাবতীয় সহায় সম্বল হারিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এ অঞ্চলের প্রায় ৪০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয় এবং ৭০ হাজার বাড়িঘর বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। ফসলের জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যা দূর্গত এলাকায় পুলিশ সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজস্ব নৌ-যান এবং স্থানীয় নৌ-যানের মাধ্যমে বন্যা কবলিত মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পৌছে দিয়েছে। এছাড়াও পুলিশের অর্থায়নে দূরবর্তী বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রান সামগ্রী (রান্না করা খাবার, শুকনো খাবার, মোমবাতি, টর্চ লাইট, সুপেয় পানি, স্যালাইন, ঔষধ ইত্যাদি) বিতরণ করে। এছাড়াও যেকোন ধরনের প্রাকৃতিক দূর্যোগ ও অগ্নিকান্ডের ঘটনা মোকাবেলায় পুলিশ অগ্রণী ভূমিকা পালা করে।

 

দায়িত্ব পালনকালে শাহাদাৎ বরণকারী উল্লেখযোগ্য পুলিশ সদস্যগন্ধে মধ্যে এআইজি (অপারেশন্স), পুলিশ হেডকোয়াটার্স জনাব সাঈদ তারিকুল হাসান বিপিএম, পুলিশ সুপার জনাব নিজাম উদ্দিন, এপিবিএন বগুড়া, পুলিশ সুপার জনাব মিজানুর রহমান, ডিসি, সিএমপি, প্রমুখসহ অনেক থানার অফিসার ইনচার্জগণ এবং বিভিন্ন পদ-মর্যাদার পুলিশ সদস্যবৃন্দ কর্তব্যকালীন ও করোনাকালীন সময়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। হঠাৎ দুর্ঘটনাজনিত কারণেও অনেক পুলিশ সদস্য মারা যাচ্ছে। দায়িত্ব পালনের সময় সড়কে ধুলাবালি ও পরিবেশ দূষণের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে । আবার খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম, রাস্তায় ডিউটি, ঘুম, বিশ্রামের অভাবের ফলে পুলিশ সদস্যদের নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়।গত পাঁচ বছরে কর্তব্য পালনরত অবস্থায় ২০১৮ সালে ১৩০ জন, ২০১৯ সালে ১৭৯ জন, ২০২০ সালে ২০৮ জন, ২০২১ সালে ১৩৮ জন, ২০২২ সালে ১২১ জন এবং করোনাকালীন সময়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানকল্পে বিভিন্ন পদমর্যাদার ১০৭ জন পুলিশ সদস্য শাহাদাৎ বরন করেছেন। তাছাড়াও ২০২২ সালে চাকুরিরত অবস্থায় ২৯১ জন পুলিশ সদস্য মৃত্যুবরন করেন।

 

জঙ্গি, সন্ত্রাস ও মাদকমুক্ত দেশ প্রতিষ্ঠা করতে বাংলাদেশ পুলিশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ৷জঙ্গি দমনে পুলিশ বাহিনীর অনেক অকুতোভয় বীর সদস্য তাঁদের প্রাণ উৎসর্গ করেছেন । তাঁদের মধ্যে ২০১৬ সালে হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় শাহাদাৎ বরণকারী তৎকালীন সহকারি পুলিশ কমিশনার জনাব রবিউল ইসলাম, ডিবি, ডিএমপি এবং পুলিশ পরিদর্শক(নিরস্ত্র) জনাব মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, অফিসার ইনচার্জ, বনানী থানা উল্লেখযোগ্য। ২০১৭ সালের ২৫শে মার্চ সিলেটের শিববাড়ির পাঠানপাড়া এলকায় “আতিয়া মহলে” ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের পরিদর্শক জনাব মনিরুল ইসলাম ও চৌধুরী আবু কয়ছর এবং র‌্যাব এর তৎকালীন ইন্টেলিজেন্স প্রধান জনাব লেঃ কর্ণেল আজাদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এছাড়াও হামলায় ০৪ জন সাধারণ নাগরিক নিহত হন। ঘটনাস্থলে আমি দায়িত্ব পালন করছিলাম। ঘটনার সময় পরিদর্শক মনিরুল ও আবু কয়ছর আমার পাশেই ছিলেন। একটু দূরে ছিলেন এএসআই জনি লাল দেব ও এসআই পারভেজ এবং তৎকালীন সময়ে দক্ষিণ সুরমা থানার অফিসার ইনচার্জ, পুলিশ পরিদর্শক জনাব হারুন-অর-রশিদ, এসি দস্তগীর, ওসি মোগলাবাজার খায়রুল ফজলসহ অনেক পুলিশ সদস্য।

 

সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন দায়িত্ব পালনকালে ইন্সপেক্টর জনাব মোনায়েম ২০০৯ সালে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন । ইন্সপেক্টর মোনায়েম অত্যন্ত দক্ষ ও চৌকস অফিসার ছিলেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বভিাগের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তখন আমি রেঞ্জ ডিআইজি, সিলেট মহোদয়ের স্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। সেইদিন সকালেই তাঁর সাথে দেখা। হাসিমাখা মুখ। বিকালে শুনি ইন্সপেক্টর মোনায়েম সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত। ২০১৪ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে পিকেট ডিউটি করাকালে এসআই নুর মোহাম্মদ সিকদার মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুর কিছু সময় পূর্বেও তার সাথে আমার দেখা হয় এবং দীর্ঘ আলাপচারিতা হয় । তিনি সব সময় হাসিখুশি ও ডিউটি করাকালীন প্রাণোচ্ছল থাকতেন । অতি সম্প্রতি গত ২৬/০২/২০২২খ্রিঃ রাত অনুমান ২৩.০০ ঘটিকার সময় সিলেট জেলা বিশেষ শাখা, সিলেট এর গোয়াইনঘাট জোনে কর্মরত এএসআই(নিঃ) জনাব আবুল কাশেম চৌধুরী থানা কম্পাউন্ডে অবস্থানকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার, হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। স্বজন হারানো প্রতিটি পরিবার এই বেদনা আমৃত্যু বয়ে বেড়ায় ।

 

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ১৯৭১ সালের ২৫-এ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স এর পুলিশ সদস্যগণ পাকহানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন । এর ফলে সূচিত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ । ১৪ হাজার বাঙ্গালি পুলিশ সদস্য সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। থানা, ফাঁড়িতে কর্মরত পুলিশ সদস্যগণও স্বতস্ফুর্তভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ১১০০ জনের বেশি পুলিশ শাহাদাৎ বরণ করেন। বাংলাদেশ পুলিশের সম্মানিত আইজিপি জনাব চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, বিপিএম (বার), পিপিএম মহোদয় বলেন “নির্যাতিত মানুষের প্রথম আশ্রয়স্থল হলো পুলিশ।ওসি হতে পারেন ঐ থানার সামাজিক নেতা। মানুষ তাকে ভালবাসবে, তার কথা শুনবে, তার ফোর্সকে ভালবাসবে ।পুলিশ হবে জনতার, পুলিশ হবে মানবিক। জনগণের সেবা করাই পুলিশ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যেরপবিত্র দায়িত্ব”।

 

বাংলাদেশ পুলিশ শুধু দেশে নয়, দেশের বাহিরেও আন্তজার্তিক পরিমন্ডলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছে। এযাবৎকালে বাংলাদেশ পুলিশের প্রায় ২১০০০ জন সদস্য জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার সুমন দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্তএকজন অতিরিক্ত আইজিপিসহ বাংলাদেশ পুলিশের ২২ জন সদস্য বিশ্ব শান্তিরক্ষার্থে জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং ১২ জন সদস্য আহত হয়েছেন। তাঁদের এই মহান আত্মত্যাগ আমাদের কাছে বেদনার পাশাপাশি গর্বেরও।

 

নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনের সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে পেশাগত উৎকর্ষত ও কার্যক্ষমতা। বৃদ্ধি পেয়েছে পুলিশের চিকিৎসা সেবাও। কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে উন্নতমানের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। বর্তমান সরকারের রূপকল্প ২০৪১ কে সামনে রেখে দেশে বেশ কিছু মেগা প্রজেক্ট চলমান আছে। চলমান বিভিন্ন মেগা প্রজেক্টে বাংলাদেশ পুলিশ নিরাপত্তা দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ পুলিশ ক্রীড়াক্ষেত্রেও অনবদ্য অবদান রেখে চলেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশের ফুটবল দল বাংলাদেশ প্রিমিয়ার ডিভিশন লীগে খেলার সুযোগ করে নিয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ ভলিবল ও কাবাডি দল জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশ পুলিশ মাদক উদ্ধার ও জঙ্গি দমনে বহির্বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে এবং মাদকের বিরুদ্ধে শুন্য সহিষ্ণুতা নীতি ঘোষণা করেছে। মাদক সংশ্লিষ্টতার কারণে অনেক পুলিশ সদস্যকে ইতোমধ্যে চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে।

 

দেশের সড়ক, মহাসড়ক, রেলপথ, শিল্প-কারখানা ও এয়ারপোর্টগুলোর নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে পুলিশ। পর্যটকদের নিরাপত্তা বিধান ও মৎস্য সম্পদ রক্ষায় দায়িত্বপালন করছে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ট্যুরিস্ট পুলিশ ও নৌ-পুলিশ। প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবারের মায়াত্যাগ করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনারবাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় জীবন উৎসর্গকারী সকল বীর পুলিশের আত্মার শান্তি কামনা করি। আইজিপি জনাব চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, বিপিএম (বার), পিপিএম মহোদয়ের গতিশীল নেতৃত্বে বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ যেমন জনগণের পুলিশ এবং প্রতিটি জণগণের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে তেমনি ভবিষ্যতেও পুলিশের কর্মকান্ডের এধারা অব্যাহত থাকবে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর