ঢাকা ২রা এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৯শে চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৪:১৫ অপরাহ্ণ, মার্চ ২৮, ২০২৩
মো. লোকমান হেকিম
দেশে বহু দিন ধরেই দফায় দফায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে অনেক পণ্যের দাম। আমন ধান কাটা প্রায় শেষ হয়ে এলেও চালের বাজারে মিলছে না সুখবর। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে প্রান্তিক ও শ্রমজীবী মানুষজনের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। দাম বাড়ার পেছনে কোনো সিন্ডিকেটের হাত আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা দরকার। নতুবা বাজার আবারও অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। আর স্বাভাবিক কারণে হলে সমস্যা খুঁজে অবশ্যই এর সমাধান করা উচিৎ।
চাল, ডাল, ডিম, চিনি, তেলসহ প্রায় প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। শীতের সবজিতেও ফেরেনি স্বস্তি। ভরা মৌসুম চললেও প্রায় সব সবজির দাম চড়া। কোনো সবজিই এখন স্বাভাবিক দামে পাওয়া যাচ্ছে না। জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুৎকে বলা হয় আধুনিক অর্থনীতির ‘জীবনীশক্তি’, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবাহ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। সব ধরনের পণ্য ও সেবা এবং মানুষের জীবনযাত্রায় এগুলোর রয়েছে তীব্র প্রভাব। অর্থাৎ এসব পণ্য ও সেবা ছাড়া এখন মানুষের জীবনযাত্রা কল্পনাও করা যায় না যে কারণে এসব পণ্যের দাম দেশে কিংবা বিদেশে বাড়লে এর নেতিবাচক প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে দেশীয় আর্থিক ব্যবস্থাপনায় এসে পড়ে।
কিন্তু আমাদের দেশে সরকার সাধারণ মানুষের কথা বিবেচনায় না নিয়ে দফায় দফায় এসব পণ্য বা সেবার মান বাড়িয়েছে। গত সাত মাসে ছয়বার বাড়ানো হয়েছে গ্যাস, বিদ্যুৎ, তেল ও সারের দাম। এর প্রভাবে সব ধরনের পণ্য ও সেবার দাম বেড়ে গেছে।
একদিকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত রয়েছে; টাকার মান কমে গিয়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অন্য দিকে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় যাপিত জীবনের মান কমছে। ব্যয়ভার সমন্বয় করতে গিয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে মানুষের জীবন। একই সাথে সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত জুন থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে দু’দফা। প্রতি দফায় এর দাম বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। ৫ জুন গ্যাসের দাম বেড়েছে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ১৮ জানুয়ারি বেড়েছে ১৮০ শতাংশ। এর আগে ১২ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ৫ শতাংশ। ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয় ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ৫ আগস্ট জ্বালানি তেলের দাম ৪২-৫২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল। ১ আগস্ট সারের দাম বাড়ানো হয় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। গত সাড়ে সাত মাসে চার ধরনের সেবার দাম ছয় দফায় বাড়ানো হয়েছে। সঙ্গত কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সব খাতে। শিল্পের উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। বেড়েছে পণ্যের দাম যা মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যয়বহুল করে তুলেছে। একই সাথে গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহন ভাড়া বেড়েছে লাগামহীনভাবে। শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি ক্যাপটিভ পাওয়ার। সেই ক্যাপটিভ পাওয়ারের দাম একবারে ৮৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। প্রতি ঘনমিটার ১৬ টাকার জায়গায় এখন দিতে হবে ৩০ টাকা। এতে পণ্য উৎপাদন খরচ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যাবে যদিও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সব মিলিয়ে পণ্য ও মানুষের চলাচলের খরচ বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর কারণে কৃষি খাতে উৎপাদন খরচ বেড়ে চলেছে। গ্যাসের দাম যেভাবে বাড়ানো হয়েছে, তাতে গ্যাসভিত্তিক পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাবে।
এর আগেও জ্বালানি তেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর সাথে কাঁচামাল ও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া তো আছেই। বাস্তবে ডলার, জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধিতে শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচ ইতোমধ্যে ২৫-৫০ শতাংশ বেড়েছে। শিল্পপণ্যের দাম বেড়েছে ৩০-৫০ শতাংশ। কৃষিপণ্যের দামও বেড়েছে। পণ্যের দাম বাড়লেও ভোক্তার আয় কমেছে। তাই সার্বিকভাবে সব ধরনের পণ্যের বিক্রি কমেছে যে কারণে প্রায় সব ব্যবসায় মন্দা চলছে। সব মিলিয়ে ভোক্তার কাঁধে চাপ বাড়ছে। মন্দায় আয় বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় জীবনযাত্রার মানের সাথে আপস করতে হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষকে।
অবস্থা এমন সঙ্গীন যে, আমাদের দেশে খাবারে পুষ্টিমান ঠিক রাখা এখন কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিপুল জনগোষ্ঠীর। বিনোদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ এসব খাতে ব্যয় কমাতে হচ্ছে মধ্যবিত্তদের। ফলে ওই সব খাতে মন্দা আরো জেঁকে বসবে। পণ্যের বাড়তি দামে ভোক্তার নাভিশ্বাস উঠেছে। আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতিতে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছেন। নতুন সঞ্চয়ও করতে পারছেন না। এর নেতিবাচক প্রভাব তীব্রভাবে পড়েছে ব্যাংকের আমানত সংগ্রহে। বাস্তবতা হলো- দেশের অর্থনীতি দিন দিন সঙ্কটে পড়ছে। এ জন্য সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। তবে সরকার যেভাবে অর্থনৈতিক সঙ্কট সামাল দিতে চাচ্ছে তাতে আপাতত সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘব হবে বলে মনে হয় না।
লেখক: শিক্ষক-কলামিস্ট, মোবা: ০১৭১৬-২৭০১২০
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by syltech