ঢাকা ২রা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:১৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
সুয়েব রানা
দেশের বিভিন্ন বাগানে কাজ করা চা শ্রমিকদের জীবন আটকে গেছে বাগানের চার সীমানায়। যুগ যুগ ধরে বাগানের জমিতেই তাদের বসবাস। বাগানের দেওয়া জায়গাতেই তাদের থাকতে হয়, নেই কোন স্থায়ী অধিকার। মাথা গোঁজার আশ্রয়টুকু ধরে রাখতে হলে পরিবারের কোন না কোন ব্যক্তিকে বাগানে কাজ করতেই হবে। দেশের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় ২৪১টি চা বাগানে কাজ করা শ্রমিকদের জীবন প্রায় একই সূত্রে গাঁথা। প্রতিদিন তাদের পরিশ্রমের সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হয়।
সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর মেলে সর্বোচ্চ রোজ ১৭৮.৫০ টাকা, তাতেই সন্তুষ্টি। নেই কোন হতাশার চাওয়া পাওয়া। তা দিয়ে কখনো ভাত খেয়ে, কখনো না খেয়ে দিন যাপন করতে হয়। মেদহীন অক্লান্ত পরিশ্রমী শরীরে মাথায় করে বয়ে চলেছেন চা পাতার বোঝা। বাগানের অগোছালো পরিবেশে বেড়ে ওঠে তাদের সন্তান ও পরিবার। প্রায়ই ভোগে অপুষ্টিসহ নানা রোগে। নেই কোন উন্নত শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা। সুযোগও সীমিত।
বর্তমানে কিছু শ্রমিকরা ভালোভাবে বেঁচে থাকার আন্দোলনে ন্যূনতম মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে মাঝেমধ্যে ধর্মঘটন করে যাচ্ছেন। বৈঠকের পর বৈঠক হলেও আসানো রূপ কোন সমাধান মিলছে না। সকল শ্রমিকদের একটাই চাওয়া বাংলাদেশের সরকার যেন তাদের দিনান্ত শ্রমের কাঙ্ক্ষিত মজুরি পায়, সুযোগটুকু করে দিতে। এই বাগানই তাদের শেষ আশ্রয়স্থল। তাদের আত্মার সাথে মিশে আছে এই বাগানের মাটি ও কর্ম।
জানা যায়, বাংলাদেশে চা চাষের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ আর পুরাতন। ১৮৫৪ সালে সিলেটে যখন চায়ের বাগান করে চা উৎপাদন শুরু হয় তখন সিংহভাগের দখলে ছিল ব্রিটিশ বণিকরা। মাইলের পর মাইল বিশাল এই চা বাগানে কাজ করার জন্য দরকার ছিল বিপুল শ্রমিক। বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিচু বর্ণের হিন্দু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর লোকজনকে কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চা বাগান এলাকাগুলোতে নিয়ে আসা হয়। চা বাগানের মাঝে ছোট মাটির ঘরে চাশ্রমিকদের বসবাস শুরু হয়।
রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে একটি কুঁড়ি আর দু’টি পাতা ছিড়ে সৌখিন মানুষের কাপে চা পৌঁছে দিচ্ছে চাশ্রমিকরা। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেক সময়, ভারত ভাগ হয়েছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু চা শ্রমিকদের ভাগ্য চা বাগানের হাড়ভাঙা খাটুনির গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে আছে। বংশানুক্রমে সমাজের মূলধারা থেকে বিছিন্ন এই মানুষগুলোর নিজেদের ভূমির অধিকার নেই। ইংরেজ আমলে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এই শ্রমিকেরা মাইলের পর মাইল পাহাড়ি টিলা আর ঢাল পরিষ্কার করে চা বাগানের সূত্রপাত করেছিল। বিনিময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই মানুষেরা চাশ্রমিকের কাজটিই করে যাচ্ছে।
মোট চা শ্রমিকের প্রায় ৬৪ শতাংশই নারী এবং তাদের প্রায় সবাই খুব ছোটবেলা থেকেই চা বাগানে কাজকরা শুরু করেছে। প্রতিটি চা-শ্রমিককে দিনে ২৩ কেজি চা পাতা তোলার লক্ষ্য দিয়ে দেয়া হয়। বাগান বিশেষে হয়তো এই লক্ষ্যটি ১৮ থেকে ২৪ কেজিতে উঠানামা করে।
তবে এই লক্ষ্য দিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি সিলেটের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য চা বাগানেও আছে। আর এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলে কাটা যায় মজুরি। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে যেমন মজুরি কাটা যায় তেমনি লক্ষ্যের চেয়ে বেশি পাতা তুলতে পারলে প্রতি কেজি পাতার জন্য দুই থেকে তিন টাকা বাড়তি মজুরি দেয়া হয়।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই লক্ষ্য অর্জনে চা শ্রমিকেরা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাহায্য নেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবারের শিশু সদস্যদের যুক্ত করা হয়। যে বয়সে শিশুটির সময় কাটানোর কথা ছিল স্কুলের প্রাঙ্গণে সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলা করে সেখানে দু’টি পাতা আর একটি কুঁড়ির খোঁজ করতেই অস্ত যায় সোনালী সূর্য।
চা বাগানের চৌহদ্দিতে মাঝে-মধ্যেই দেখা মিলে স্কুলের। ইউনিসেফ কিংবা অন্য কোনো দাতব্য সংস্থার স্কুলের রঙিন দালানগুলো দূর থেকে ডাকতে থাকে শিশুদের। চা শ্রমিকদের অনেকেই এখন স্বপ্ন দেখেন তাদের সন্তানেরা চা বাগানের বাইরে পা রাখবে। কিন্তু সেই আশা অনেক সময় ধোঁয়ার মতো শূন্যে মিলিয়ে যায়।
প্রাথমিক কিংবা প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা হলেও চা বাগান এলাকা থেকে বহুদূরের উচ্চ বিদ্যালয়ে সন্তানদের পাঠাবার সাহস করেন না অনেকেই। তবে এর মধ্যেও খুব অল্পসংখ্যক লোক চা বাগান থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা গ্রহণ করে মূলধারার সমাজে মিশতে শুরু করেছেন।
স্বল্প মজুরিতে ক্রমবর্ধমান পরিবারের চাহিদা মেটাতে একই পরিবার থেকে অনেকেই চা বাগানে কাজ নিতে শুরু করে। পরিবার আলাদা হয়ে গেলে চা বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের নতুন আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়। এই স্বল্প মজুরিতে যেখানে তাদের জীবন ধারণই কঠিন সেখানে তাদের কেউ টাকা সঞ্চয় করে জমি কিনে মূলধারার সমাজে বসবাস শুরু করবে এই চিন্তাটিও করা কঠিন। ভাষা আর সংস্কৃতির বিস্তর ফারাকের কারণে মূলধারার বাঙালি সমাজের কাছেও নিগ্রহের শিকার এই চা শ্রমিকেরা। চা বাগানের শিশুরাও প্রাক-প্রাথমিক আর প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পেরোতেই ডাক পড়ে চা বাগানে কাজ করার। পরিবারের বয়স্ক সদস্যের কেউ চা শ্রমিকের পদ থেকে অবসর নিলে সেই পরিবারের কাউকে চা শ্রমিক হিসেবে নিবন্ধনের অগ্রাধিকার দেয়া হয়, যাতে তার পরিবারের আবাসনটি টিকিয়ে রাখা যায়।
এভাবে যুগের পর যুগ ধরে চা বাগানের ভেতরেই জীবন বাঁধা পড়ে আছে তাদের। চা বাগানের শ্রমিকেরা বংশানুক্রমে শতশত বছর ধরে চা বাগানের ভেতরের জমিতে বসবাস করেও পায় না জমির মালিকানা, এক টুকরো জমির জন্য এরা জিম্মি হয়ে আছে মালিক শ্রেণির কাছে।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by syltech