ঢাকা ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৫৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২২, ২০১৮
ডা. মাওলানা লোকমান হেকিম
আমাদের দেশে সাতশ’কোটি টাকার ফসল যাচ্ছে ইঁদুরের পেটে। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে ইঁদুর সাতশ’২৩কোটি ৭২ লাখ টাকার ফসল বিনষ্ট করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ধান, চাল ও গম। ইঁদুরের আক্রমনে বছরে আমন ধানের শতকরা ৫ থেকে ৭ ভাগ, গম ৪থেকে ১২ ভাগ, গোম আলু ৫ থেকে ৭ ভাগ, আনারস ৬ থেকে ৯ভাগ নষ্ট হয়। ইঁদুর মাঠ ফসলের ৫ থেকে ৭ভাগ, গুদামজাত শস্য ৩ থেকে ৫ভাগ ক্ষতি করে। ইঁদুর সেচনালা নষ্ট করে ৭ থেকে ১০ ভাগ। এশিয়ায় ইঁদুর বছরে ১৮ কোটি মানুষের এক বছরের খাবার খেয়ে নষ্ট করে। বাংলাদেশে ইঁদুর ৫০ থেকে ৫৪ লাখ লোকের এক বছরের খাবার নষ্ট করে।
এই প্রেক্ষাপটেই দেশে চলছে ইঁদুর নিধন অভিযান। ইঁদুর নিধনের মাসব্যাপী অভিযান শুরু হয়েছে গত ৭ অক্টোবর। চলবে আগামী ৬ নভেম্বর পর্যন্ত। এবারের এই অভিযানের শ্লোগান হচ্ছে ‘ইঁদুর ধরুন, ইঁদুর মারুন ইঁদুরমুক্ত খামার গড়–ন’। তাই স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর মধ্যে ইঁদুরের বংশবিস্তার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। খাদ্য এবং বাসস্থানের নিশ্চয়তা পেলে এক জোড়া ইঁদুর এক বছরে ৫০০ থেকে ৩ হাজারটি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে। একটি ইঁদুর বাচ্চা প্রসবের পর মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আবারো গর্ভধারণ করতে পারে। ইঁদুর ১৮ থেকে ২১ দিন গর্ভধারণের পর ৫ থেকে ১৬টি পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করে থাকে। এরা সাধারণভাবে ১ থেকে ২ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। ইঁদুরের মুখের সামনের দিকে দু’জোড়া ধারালো ছেদন দাঁত গজানোর পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বাড়তেই থাকে। দাঁতের এই বৃদ্ধি ঠেকাবার জন্য এরা সব সময়ই তাই কোন না কোন কিছু কুটকুট করে কাটতেই থাকে। দাঁত বড় হয়ে এদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইঁদুরের দৃষ্টিশক্তি খুব কম কিন্তু ঘ্রাণ ও শ্রবণ শক্তি প্রখর। দৈনিক একটি ছোট ইঁদুরের শুকনো খাবারের পরিমাণ হলো প্রায় ৩-১৬ গ্রাম, বড় ও মাঝারি ইঁদুরের ৩০-৩৬ গ্রাম এবং পানি ১০-৩০ সিসি পর্যন্ত। পানি ছাড়াও ইঁদুর কয়েক দিন বেঁচে থাকতে পারে। তবে এরা যতটুকু খায় তারচেয়েও বেশি নষ্ট করে। একটি ইঁদুর তার শরীরের ওজনের এক-দশমাংশ পরিমাণ খাবার খেয়ে থাকে, বাকিটুকু কেটে নষ্ট করে।
একটি ইঁদুর বছরে প্রায় ৫০ কেজি শস্য নষ্ট করে থাকে। মাঠের ধান বা গম, গাছের কুশি পর্যায়ে কান্ড তেরছাভাবে এবং শিষ বের হলে শিষ বাঁকিয়ে নিয়ে কচি শিষগুলো কেটে দেয়। এরা আমন ধান ও গম ক্ষেতের বেশি ক্ষতি করে থাকে। প্রতি রাতে একটি ইঁদুর ৩০০-৪০০টি কশি এবং ১০০-২০০টি পর্যন্ত শিষ কাটতে পারে। এছাড়াও ইঁদুর ফল (নারিকেল, আনারস) সবজি, চীনাবাদাম ও আলু ফসলের বেশি ক্ষতি করে থাকে। এসব ফসলে ইঁদুর স্পষ্ট গর্ত করে এবং কোন কোনটি টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে। সঠিক ব্যবস্থা নেয়া না হলে গুদামজাত শস্যেরও বিরাট একটি অংশ ইঁদুর নষ্ট করে থাকে।
ইঁদুর মানুষ, পশুপাখি এবং পরিবেশেরও ক্ষতি করে থাকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। যেমন-বসতবাড়ির আসবাবপত্র, খাবার, বইপত্র, মূল্যবান দলিলপত্রাদি, কাপড়চোপড় এবং মাঠে জমির আইল, সেচ নালা, বৈদ্যুতিক তারের আবরন এমন কি মূল্যবান অনেক যন্ত্রপাতিরও ক্ষতি করে থাকে। ইঁদুর গ্রামে কাঁচা ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট সড়ক-মহাসড়ক, বাঁধ, খাল-পুকুরের পাড়, রেললাইন এসব স্থানে গর্ত খুঁড়ে স্থাপনাগুলোর স্থায়িত্ব কমিয়ে দেয়। এছাড়া ইঁদুর বেশ কিছু মারাত্মক রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে। যেমন- টাইফুয়েড, প্লেগ, জন্ডিস, আমাশয়সহ ৩৩ প্রকারের মারাত্মক রোগের বাহক। মলমূত্র ত্যাগ করে এরা খাবার নষ্ট করাসহ পরিবেশ দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
আমন ধানে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস এবং গম ফসলে জানুয়ারী মাস হলো ইঁদুর নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। এ সময়ে এদের সংখ্যা কম থাকে বলে এদের মেরে সংখ্যা কমিয়ে বা এদের খাবারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বংশবিস্তার যদি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় তাহলে ফসল রক্ষার পাশাপাশি খাদ্য শস্য নষ্ট হওয়ার হারও অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। বাংলাদেশে ১৯৮৩ সাল থেকে প্রতি বছর ইঁদুর নিধন অভিযান কর্মসূচী পরিচালিত হয়ে আসছে। বিশেষ এ কর্মসূচি গ্রহণের ফলে প্রতি বছর প্রায় অর্ধ কোটির মত ইঁদুর মারা সম্ভব হচ্ছে। ইঁদুর নিধন বা নিয়ন্ত্রণ দু’ উপায়ে করা যায়। এক. অরাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় এবং দুই. রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায়। তবে ইঁদুর নিধন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নির্ভর করে মূলত: ইঁদুরের প্রজাতি ক্ষতির ধরন, পরিমাণ, ফসলের অবস্থা এবং সময়ের ওপর। আবার অনেক সময় একটি নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা কার্যকর নাও হতে পারে বা একাধিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণের দরকার হতে পারে ।
অরাসায়নিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা :
* ইঁদুরের উপস্থিতি : বসতবাড়ি, গুদাম বা মাঠে এদের উপস্থিতি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হয় এবং উপস্থিতি বুঝা মাত্রই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিতে হয়।
* বসতবাড়ি বা ক্ষেত পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে : পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন স্থানে ইঁদুর থাকে না। তাই বসতবাড়ির নোংড়া আবর্জনা সরিয়ে বা ক্ষেত আগাছামুক্ত রেখে ইঁদুরের উপস্থিতি সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
* বসতবাড়ি বা ক্ষেতের আশপাশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে: বসতবাড়ি বা এর আশেপাশের অবাঞ্ছিত ঝোপ-জঙ্গল পরিস্কার করে, খাবার-দাবার ঢেকে রেখে, উচ্ছিষ্ট খাবার যেখানে-সেখানে না ফেলে এবং মাঠে ক্ষেতের আশেপাশের ও আইলের বড় ঘাস বা আগাছা বা ঝোপ-জঙ্গল কেটে পরিস্কার করে পরোক্ষভাবে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ করা যায়।
*আইল চিকন রেখে : ক্ষেতের আইল ছেঁটে চিকন বা ছোট ছোট করে রাখলে ইঁদুর আইনে গর্ত করে অবস্থান করতে পারে না এবং পরোক্ষভাবে ক্ষেতে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ হয়।
*ফাঁদ পেতে ইঁদুর ধরে: ভিন্ন ভিন্ন ধরনের ফাঁদ পেতে বিভিন্ন জাতের ইঁদুর মেরে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ইঁদুর সাধারণত: ঘরের দেয়াল ঘেঁষে চলাচল করে থাকে। চলাচলের রাস্তায়, মাচায় বা ঘরের যেসব জায়গায় ইঁদুরের আনাগোনা বেশি সেখানে এবং মাঠে সদ্য মাটি তোলা গর্তের ৩০সেমি. দূরে ফাঁদ স্থাপন করতে হয়। বিভিন্ন ধরনের ফাঁদের মধ্যে চিটাগুড়ের কলসি ফাঁদ, কাঠ বা লোহার তৈরি ফাঁদ, লাউয়ের খোলস দিয়ে তৈরি ফাঁদ, সটকি কল, ক্যাচি কল ইত্যাদি। ফাঁদে শুটকি মাছ, নারিকেল শাঁস, বিস্কুট, রুচি ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
* গর্তে পানি ঢেলে : ইঁদুরের গর্তে পানি ঢেলে ইঁদুরকে গর্তের বাইরে এনে মারা সম্ভব।
* গর্ত খুঁড়ে : ইঁদুরের উপস্থিতি আছে বা সদ্য তোলা গর্ত খুঁড়ে ইঁদুর মেরে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। সাধারণত: ফসল ক্ষেতে বা ক্ষেতের আইলের গর্ত খুঁড়ে এধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। মাঠে ফসল থাকা অবস্থায় ব্যবস্থা নিতে গেলে ফসলের ক্ষতি হতে পারে, তাই ফসল সংগ্রহ শেষে এধরনের ব্যবস্থা নিতে হয়।
* ধোঁয়া দিয়ে : ক্ষেত থেকে ধান বা গম সংগ্রহ শেষে শুকনো মরিচ পুড়িয়ে সেটি সাথে সাথে গর্তের মুখে ধরলে বা ভেতরে ঢুকিয়ে দিলে যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়, তা ইঁদুরকে বাইরে বের হয়ে আসতে বাধ্য করে। বাইরে বের হওয়া ইঁদুর পিটিয়ে মেরে ফেলতে হয়।
* একসাথে চাষ করা : একই জাতীয় ফসল মাঠে একসাথে চাষ করলে এবং একই সময়ে সংগ্রহ করলে দীর্ঘসময় পর্যাপ্ত খাবার না পেয়ে ইঁদুরের জন্মহার কমে গিয়ে পরোক্ষভাবে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ হয়।
* প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করা : বসতবাড়ি গুদাম বা যেখানে খাবার জাতীয় জিনিস রাখা হয়, সেসব স্থানে ঢোকার পথে যেসব ফাঁক থাকে প্রয়োজনানুযায়ী ধাতব পাত দিয়ে বা চিকন বুননের তারের জালে দিয়ে যেসব স্থানে অনুপ্রবেশ পথ বন্ধ করা যায়।
* আঠা ফাঁদ ব্যবহার করা : ইঁদুর ধরার জন্য ঘরে বা গুদামে কাঠবোর্ড, মোটা শক্ত কাগজ, সমান টিন, হাডবোর্ড ইত্যাদির ওপর বিষমুক্ত আঠা লাগিয়ে রাতে ইঁদুর চলাচলের রাস্তায় রেখে দিতে হয় অথবা মাঝে লোভনীয় খাবার খেতে এসে আঠায় ইঁদুর আটকে যায়। আটকে পড়া ইঁদুর মেরে ফাঁদের লোমগুলো পুড়িয়ে ফাঁদে আরো আঠাযুক্ত করে ফাঁদটি আবার ব্যবহার করা যায়।
* জৈবিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে: অনেক পরভোজী প্রাণী আছে যারা ইঁদুর ধরে খায়। যেমন- বিড়াল, পেঁচা, ঈগল,বনবিড়াল,শিয়াল, বেজি, সাপ, গুইসাপ ইত্যাদি প্রচুর ইঁদুর ধরে খায়। পরিবেশে এসব উপকারী প্রাণীর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে পারলে ইঁদুরের সংখ্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে।
* ইঁদুর নিধন কর্মসূচির মাধ্যমে: প্রতি বছর ২-৩ বার বিভিন্ন ফসলে ইঁদুরের উৎপাত শুরু হওয়ার আগেই ইঁদুর নিধন অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে ইঁদুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হতে পারে। এজন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধিমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণের পাশাপাশি ইঁদুর নিধনের জন্য ইঁদুরের বিষটোপ বা ফাঁদ প্রাপ্তির বিষয়টিও নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
* রাসায়নিক পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা : পৃথিবীর অনেক দেশের মত বাংলাদেশেও রাসায়নিক পদ্ধতিতে ইঁদুর নিধন কার্যক্রম চলে আসছে।
বিষক্রিয়ার ওপর ভিত্তি করে রাসায়নিক পদ্ধতিকে আবার দু’ভাগে ভাগ করা যায় । ১. তীব্র বা তাৎক্ষণিক বিষ, ২. দীর্ঘ মেয়াদী বিষ বাংলাদেশে যেসব অনুমোদিত বিষ বাজারে পাওয়া যায় তাদের মধ্যে জিংক ফসফরাইডই তীব্র বা তাৎক্ণণিক বিষয়। এ বিষ খেলে ইঁদুর সাথে সাথে মারা যায়।
মৃত ইঁদুরও বিষটোপ স্থাপনের জায়গার আশেপাশে পড়ে থাকে। তাই এ ধরনের বিষটোপ কৃষকরা বেশি পছন্দ করে থাকেন। সদ্য মাটি তোলা গর্তের আশেপাশে বিকেলে কাগজের বা গাছের পাতার ওপর ৫ গ্রাম পরিমাণ জিংক ফসফাইড বিষ রেখে দিলে ইঁদুর সন্ধ্যার পরপরই গর্ত থেকে বের হয়ে এসে খায় এবং মরে যায়। আবার গর্তের মুখের মাটি সরিয়ে দিয়ে ৫ গ্রাম বিষটোপ কাগজের পুটলিতে বেঁধে গর্তের ভেতরে ঢুকিয়ে মুখ বন্ধ করে দিতে হয়। ইঁদুর কাগজের পুটলিসহ বিষয়টোপ ভেতরে নিয়ে যায় এবং বাচ্চাসহ খেয়ে মারা যায়।
লেখক : চিকিৎসক ও কলামিস্ট।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by Yellow Host