ঢাকা ২রা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৬:৪০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২১, ২০২৪
নাহিম মিয়া, কোম্পানীগঞ্জ
ঝুঁকিতে রয়েছে সিলেটের বৃহৎ দ্বিতীয় ‘ধলাই সেতু।’ সেতুর নিচ থেকে অবৈধভাবে বালু-পাথর উত্তোলন চলছে। প্রতিদিন শতাধিক বারকি নৌকার মাধ্যমে নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করছেন দুষ্কৃতিকারীরা। সেতুর নিচ এবং দুই পাশে ৫০ থেকে ২০০ গজের মধ্যে বালু উত্তোলনের ফলে এ সেতু এখন ঝুঁকিতে। সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর ও উত্তর রনিখাই ইউনিয়নের মানুষের নিজ গৃহে যাওয়ার একমাত্র সড়ক মাধ্যম এই ধলাই সেতু।
সরেজমিন ধলাই সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেতুর দুই পাশে এবং নিচ থেকে অবাধে বালু/পাথর উত্তোলন চলছে। বারকি নৌকায় করে বালু এবং পাথর তুলে নদীর পাড়ে স্তূপ করে রাখা হয়। পরে ট্রাক্টরে করে নেওয়া হয় পাশ্ববর্তী বিভিন্ন সাইটে/ স্টোন ক্রাশারে। সেখানে পেলোডারের মাধ্যমে হাইড্রোলিক ট্রাকে লোড দিয়ে বালু বিক্রি করা হয়, পাথর মেইল বা স্টোন ক্রাশারের মাধ্যমে আবার ভাঙা হয়।
স্থানীয়রা জানান, গত দেড়-দুই মাস ধরে এই অবৈধ বালু ব্যবসা চলছে। স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা দায়সারা দুয়েকটি অভিযান দিয়েছেন। ফলে বালুখেকুরা বেপরোয়া হয়ে গেছে। নির্বিঘ্নে বালু উত্তোলন চলছেই। সেতুটি ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এদিকে গত ৫ নভেম্বর ধলাই ব্রিজের নিচ থেকে বালু-পাথর উত্তোলন বন্ধের জন্য কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর অভিযোগ দায়ের করেন রুস্তমপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. ফয়জুল হক। অভিযোগে তিনি জড়িতদের অনেকের নাম উল্লেখ করেন। কিন্তু অজানা কারণে পরবর্তীতে অভিযোগের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বর্তমানে প্রায় প্রতিদিন স্থানীয়দের অনেকেই ফেসবুকে নিজ নিজ আইডিতে ব্রিজ রক্ষার স্বার্থে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন এবং প্রতিবাদ করছেন। ১৪ ডিসেম্বর ‘সাদেক আলী’ নামে স্থানীয় একজন ফেসবুক আইডি থেকে ৫৭ সেকেন্ডের একটি লাইভ ভিডিও শেয়ার করেন। লাইভে তিনি সকাল বেলা ব্রিজের নিচ থেকে অসংখ্য বারকি নৌকার মাধ্যমে বালু-পাথর উত্তোলনের দৃশ্য দেখা যায় এবং প্রতিবাদ করেন। ১৬ ডিসেম্বর বিকাল ৫ টায় ‘সোহেল আহমদ’ নামের আইডি থেকে স্থানীয় আরেকজন ৪ মিনিট ১৮ সেকেন্ডের একটি লাইভ ভিডিও শেয়ার করেন। লাইভে তিনি কালাসাদেক বিজিবি পোস্টের কাছেই ব্রিজের নিচ থেকে বালু উত্তোলনের দৃশ্য দেখান এবং প্রতিবাদ করেন।
জানা গেছে, ব্রিজের কাছে এবং নদীর পাড়ে বাড়ি ও জমির দখল থাকায় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ বালু ব্যবসা করছেন একদল দুষ্কৃতি চক্র। এ ছাড়াও বালু ব্যবসার জন্য তারা একাধিক সাইট ভাড়া দিয়ে হাইড্রোলিক ট্রাক প্রতি ১ হাজার টাকা করে চাঁদা আদায় করছেন। অদৃশ্য কারণে এসব কথিত জমির মালিক ও বেপরোয়া বালুখেকো সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে নেওয়া হচ্ছে না যথাযথ আইনি পদক্ষেপ।
দ্য কুরআনিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিজাম উদ্দিন বলেন, সচেতন সমাজের ব্যানারে মানববন্ধন করেছিলাম। তারপরও বালু উত্তোলন বন্ধ হয়নি। স্থানীয় বাসিন্দা ও সাবেক মেম্বার মো. আরাফাত আলী জানান, এই সেতুটি রক্ষার জন্য আমরা অনেক পদক্ষেপ নিয়েছি। অনেক দাবি প্রশাসনের কাছে পেশ করেছি। কিন্তু, কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং অবিরত বালু-পাথর উত্তোলন হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই সেতুটি রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
কালিবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়নরত, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী ফয়জুর রহমান বলেন, ধলাই সেতুটি হলো সিলেট জেলার সবচেয়ে বৃহত্তম সেতু, এটি কোম্পানীগঞ্জের মানুষের কেবল যোগাযোগের মাধ্যমই নয়, বরং এটি পুরো দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের একটা মাধ্যম বটে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় স্থানীয় অসাধু এবং অর্থলিপ্সু মানুষ সেতুটির নিচ থেকে বালু খনন করে সেতুটিকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, এক্ষেত্রে উপজেলা প্রশাসনও সেতুটি রক্ষার্থে মোটাদাগে ব্যর্থ। এমতাবস্থায় কোম্পানীগঞ্জ তথা দেশের স্বার্থেই যেকোনো উপায়ে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ব্রিজটিকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসা উচিৎ।
কোম্পানীগঞ্জ ছাত্র কণ্ঠ কোছাক এর সাধারণ সম্পাদক এহসানুল মাহবুব বলেন, ধলাই সেতু রক্ষার দাবিতে প্রেস কনফারেন্স ও জেলা প্রশাসক বরাবর, সড়ক ও জনপদ অধিদপ্তরে বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছি। কিন্তু ধলাই সেতু থেকে বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উজায়ের আল মাহমুদ আদনান জানান, এই কথাটি আমার কানে আসছে, আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান দিয়ে আসছি এবং লোকজনকে ধরে জেল/জরিমানা করছি। এই ভাবে যদি চলতে থাকে তা হলে আমরা আগের মতো খুঁটি ঘেরে বসবো সেখানে।
সওজ সূত্রে জানা যায়, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারির পাশের ধলাই নদীর উভয় তীরের মানুষের যাতায়াতের জন্য ২০০৩ সালে সেতুটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১২ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মিত প্রায় ৪৩৪ দশমিক ৩৫ মিটার দীর্ঘ ও ৯ দশমিক ৫ মিটার প্রস্থের সেতুটি সিলেট বিভাগের দ্বিতীয় দীর্ঘতম। টানা তিন বছর কাজ চলার পর সেতুটি ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেতুর স্থায়িত্ব ধরা হয় ৭৫ বছর। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমান সেতুর উদ্বোধন করেন। সেতু নির্মিত হওয়ায় কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পূর্ব ইসলামপুর, উত্তর রণিখাই ইউনিয়নের অর্ধ লক্ষ মানুষ সরাসরি সড়ক যোগাযোগের আওতায় আসে।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by syltech