বাঁশের সাঁকোতে চড়ছে আগামীর সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ৬:৩৬ অপরাহ্ণ, মে ১, ২০১৯

বাঁশের সাঁকোতে চড়ছে আগামীর সম্ভাবনা

তোফায়েল হাসান মান্না

স্রষ্টার নান্দনিক সৃষ্টিশৈলী, অপার সম্ভাবনার এক অঞ্চল কানাইঘাটের ১নং লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়ন। বাংলাদেশের উত্তর পূর্ব সীমান্তের সর্বশেষ ইউনিয়ন এটি। কানাইঘাট থানার অন্তর্গত এই ইউনিয়নটি কানাইঘাট শহরের ৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থান করছে।
উত্তর পূর্বে বিশাল খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত, দক্ষিণে সুরমা নদী এবং পশ্চিমে লোভা নদী (পূর্ব থেকে সুরমা নদী পশ্চিমমুখী হয়ে এসে উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে আসা লোভা নদীর সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে) অবস্থান করছে। সুরমা, লোভা এবং ভারত সীমান্ত এই ইউনিয়নকে ভৌগলিকভাবে ভারত-বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা করে স্বতন্ত্র একটি দ্বীপে পরিণত করেছে। উল্লেখ্য যে, এই ত্রিমুখী নদী বেষ্টিত এলাকাটিতে আজও কোন সেতু স্থাপিত হয় নি। যার দরুন আজও এলাকাটি অধিকাংশ নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত।
এই লেখার সাথে সংযুক্ত ছবিতে যে চিত্র দেখা যাচ্ছে তা এই ইউনিয়নের শুষ্ক মৌসুমের একটি স্বাভাবিক চিত্র। এই ইউনিয়নের মানুষের অন্যান্য এলাকার সাথে যুগ যুগ ধরে যোগাযোগের প্রচলিত একটি মাধ্যম বাঁশের সাঁকো। এই ইউনিয়নের শত শত ছাত্রছাত্রী প্রতিদিন শিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী এলাকার স্কুল-মাদরাসাগুলোতে যাওয়া-আসা করে। স্কুল ছুটির পর বাঁশের সাঁকোতে চড়ে বাড়ি ফেরত শিক্ষার্থীদের এই ছবিটিতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এই এলাকার মানুষের দুঃখ, দুর্দশা ও দুর্বিষহ জিবনের চিত্র একটু হলেও ফুটে উঠেছে।
সীমান্ত বেষ্টিত প্রত্যন্ত অঞ্চল। নদী, পাহাড়, লেক, শিলাপর্বত, চা বাগান, ফলমূলসহ অসংখ্য দর্শনীয় স্থান এবং বালু, পাথর ,তেল, গ্যাস নিয়ে কানাইঘাটের বুকে ত্রিভূজের আকারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দ্বীপপুঞ্জের ন্যায় দাড়িয়ে আছে ১ নং লক্ষীপ্রসাদ ইউনিনিয়ন। লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নটি কানাইঘাট তথা সম¯্র সিলেটের মধ্যে বিভিন্ন কারণে অন্যতম স্থান দখল করে আছে। যেমন:
১. প্রতি বছর শত কোটি টাকার পাথর-বালু উত্তোলন করা হয় এই ইউনিয়নের অন্তর্গত লোভা নদী ও কোয়ারি থেকে।
২. পূর্ব সিলেটের প্রকৃতিক সম্পদের চাহিদা পূরণকারী অন্যতম ইউনিয়ন এটি। ব্যাপক ফল-ফলাদী ফলে এই ইউনিয়নে তার মধ্য অন্যতম কাঁঠাল।
৩. খনিজসম্পদে ভরপুর এই ইউনিয়নটি। স্বাধীনতা পরবর্তীতে এই ইউনিয়নের একটি তেলের খনি (পেট্রোল বাংলা) থেকে তেল উত্তোলন করা হয়েছে। এখনও এই খনিতে অনেক তেল মজুদ রয়েছে বলে স্থানীয়দের ধারণা।
৪. এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন পিকনিক স্পট।
৫. রয়েছে বিশাল মানবগোষ্ঠী এবং অনাবাদি জমি।
৬. ভৌগলিকভাবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া সত্ত্বেও রয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদরাসা। তবে এখনও কোন কলেজ স্থাপিত হয় নি।
৭. রয়েছে স্বাধীনতার যুদ্ধে সংগ্রাম করা মৃত্যুঞ্জয়ী অসংখ্য বীর মুক্তিযুদ্ধা, আলেম-উলামা, জ্ঞানী-গুণী, কবি সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ।
৮. দেশ বিদেশে রয়েছেন সুপ্রশিক্ষিত সেনা, নৌ, পুলিশসহ অসংখ্য সরকারী-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। রয়েছেন পেশাজীবী, সাংবাদিক, সংগঠক, ব্যবসায়ী। রয়েছেন বিভিন্ন জাতের পাহাড়ী উপজাতী, হিন্দু,বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সহ বিভিন্ন জাত-ধর্ম, শ্রেণী-পেশার মানুষ।
এত এত সম্পদ, সম্ভাবনা, মেধা-মনন, সৌন্দর্য, রূপ-লাবন্য নিয়ে আরেকটি ইউনিয়ন বাংলাদেশের মধ্যে আছে কি না আমার জানা নেই। তবুও ইউনিয়নটি পড়ে আছে দ্বীপের মত যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায়।
সম্পদ আর সম্ভাবনাময় এই এলাকাটি ভৌগলিকভাবে দ্বীপের মত হওয়ায় এই এলাকার মানুষ পিছিয়ে পড়েছে কয়েক দশক। মোবাইল-ইন্টারনেট, বিদ্যুৎ, মটরগাড়ি, সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছাড়া যেখানে আজকের যুগ অকল্পনীয় সেখানে এখনও এসবের বাতাস লাগেনি এই ইউনিয়নের মানুষের গায়ে।
দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চল এবং স্বল্প স্থলভাগের মধ্যে হাওয়র-বাওয়র নিয়ে গড়ে উঠা সড়ক থাকা সত্ত্বেও ব্রিজ না থাকার কারণে যোগাযোগবিহীন এই এলাকাটির মানুষেকে মাইলের পর মাইল পায়ে হাঁটা, ইঞ্জিনচালিত নৌকা এবং মাছ ধরার ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে নদী পাড়ি দিয়ে আজকের এই উন্নত বাংলাদেশে কঠিন থেকে কঠিনতর এবং কষ্টসাধ্য জীবন-যাপন করতে হচ্ছে।
সারা বাংলাদেশে আজকের সরকার ১০০ ভাগ বিদ্যুৎ নিশ্চিত করলেও লক্ষীপ্রসাদ ইউনিয়নের বেশির ভাগ ঘরে হাজার বছর থেকে চলে আসা প্রথাগত, নিম্নমানের এবং অস্বাস্থ্যকর কেরোসিনের বাতিতে ঘরগুলোতে আলো জ্বালাতে হচ্ছে।
ইন্টারনেট, কম্পিউটার তো দূরের কথা ছোট মুঠোফোনটা চার্জ দিতে হলে মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে চার্জ দিতে হয়।
স্বাস্থ্য সেবার মান তো আরও নিম্নে অবস্থান করছে। এই বিশাল ভূখ-ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য নেই কোন ক্লিনিক বা হাসপাতাল। এই এলাকার গর্ভবতী নারী, শিশু, দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত মানুষজন ও বৃদ্ধ পুরুষ মহিলার জন্য কতটা ঝুকিপূর্ণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হঠাৎ করে রাতের বেলা কেউ কোন ব্যধিতে আক্রান্ত হলে তার সামনে দুটি পথÑ ১. মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা। ২.মৃত্যু।
এই অবহেলিত এলাকায় গর্ভবতী নারী ও শিশুর জন্য হলেও একটি মানসম্মত ক্লিনিক/হাসপাতল সময়ের দাবী।
বর্ষার পাহাড়ি ঢল আর সুরমার উজানে বরাক নদী থেকে আগত পানি সৃষ্টি করে পর্বতসম উত্তাল বন্যার। দুদিক থেকে আগত পানির পুরো দকলটাই সইতে হয় এই এলাকার মানুষজনকে। বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয় নেওয়ার মত নেই কোন আশ্রয়কেন্দ্রে। প্রতি বছর এই উত্তাল সুরমা বা লোভা নদীর বুকে নৌকা ডুবির ঘটনা নিত্যদিনের।
বাঁশের সাঁকো এই এলাকার স্কুল পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর জন্য স্বপ্নের। সারাবছর কাদা আর বন্যার মধ্য দিয়ে স্কুলে যাওয়া শিক্ষার্থীরা যখন শুষ্ক মৌসুমে শুকনো রাস্তা আর ভয়, কাষ্টসাধ্য বিব্রতকর নৌকার পরিবর্তে বাঁশের সাঁকো পেলো, তখন তা তাদের জন্য আনন্দের হয়ে উঠে। চিন্তা করে দেখেন এই এলাকার মানুষের জন্য বর্ষাকাল কতটা ভয়ঙ্কর, কতটা দুঃখের এবং কতটা কষ্টসাধ্য? তাদের কি একটু ভালো জীবন-যাপন করার আকাক্সক্ষা জাগে না? ভালো রাস্তাঘাটের স্বপ্ন দেখে না? বাংলাদেশের আরো দশটা ইউনিয়নের মত নাগরিক জীবনমান উন্নত হোক সেটা তারা চায় না?
অবশ্যই তারা চায় এবং তাদের বহুদিনের লালিত স্বপ্ন একটি ব্রিজ। এই এলাকার শিশু ঘুমের ঘোরে গাড়ির হর্ণের শব্দ শুনে, মহিলারা শিশুদেরকে গাড়ি চড়ার স্বপ্ন দেখায় আর পুরুষরা মুখে মুখে ব্রিজ, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল, কলেজের স্বপ্নের কথা বাচ্চাদের কানে কানে বলে যায়।
সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হারিছ চৌধুরী ও গত মেয়াদের সংসদ সদস্য সেলিম উদ্দিন সময়ে সময়ে এই এলাকার মানুষকে একটি ব্রিজ স্থাপনের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে ক্ষমতার পালাবদলে মিলেয়ে গেছে সেই বহুল আলোচিত স্বপ্ন। এই এলাকার আপামর জনতার মুখে মুখে একটাই প্রশ্ন, কবে পাবো একটা স্বপ্নের ব্রিজ, বিদ্যুৎ, হাসপাতাল আর উন্নত নাগরিক জীবন?
মমতাজগঞ্জ-দর্পনগর ঘাটে একটি বিজ্র নির্মাণের জন্য সরকারের গত মেয়াদে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে আমরা জানি কিন্তু তার কোনো অগ্রগতি আমাদের জানা নেই। তাছাড়া ইউনিয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা কাড়াবাল্লা-আটগ্রাম ঘাটে একটি সেতু নির্মাণের দাবি দীর্ঘ দিনের। গত নির্বাচনের আগে বর্তমান সংসদ সদস্য আলহাজ্ব হাফিজ আহমদ মজুমদার কাড়াবাল্লা-আটগ্রাম ঘাটে একটি সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা জনি না, এই প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত কতটা বাস্তবায়িত হবে। কতটা পূরণ হবে সুবিধাবঞ্চিত এই অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন। তবে আমরা চাই, এমপি মহোদয়ের এই প্রতিশ্রুতি অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের কথার মতো যেন হারিয়ে না যায়।

লেখক: সৌদি আরব প্রবাসী।

সর্বশেষ ২৪ খবর