অবজ্ঞার অলকানন্দা

প্রকাশিত: ১:১৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০১৮

অবজ্ঞার অলকানন্দা

তকিব তৌফিক

জীবন রজনীর শেষ প্রহরে নিস্তব্ধ বিষণ্ণতা এবং ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস হয় শেষযাত্রার পরম বন্ধু। সেই সাথে কারো কারো শেষকালের সঙ্গী হয় যৌবনে অবহেলিত কোনো জড় বস্তু কিংবা জীবন্ত প্রাণ। এমন বিষণ্ণ বেষ্টনীতে আবদ্ধ সময়ে সেগুন কিংবা আকাশী কাঠ দিয়ে যত্নে গড়া নানান কারুকার্যের শখের খাটে দেহখানা আর আগের মতো জড়িয়ে থাকে না। খানিক সময় থাকলেই খাট ছেড়ে উঠে আসে অস্থির দেহটি। স্বস্তি যেনো ঘরের বাইরে খোলা বারান্দায় পেতে রাখা আশি বছরেরও পুরোনো সেগুন কাঠের সুস্তিখাটে শরীরে বিলিয়ে দেয়াতে। সুস্তিখাটে শরীর বিলিয়ে অল্প দূরে দাঁড়িয়ে থাকা, অবহেলায় বেড়ে উঠা অলকানন্দা গাছের অলকানন্দা ফুল একটা একটা করে গণনা’ই যেনো অতি উত্তম কাজ সেই প্রহরে।

যৌবনে এই উর্বর মাটিতেই গোলাপ, গাঁদা, অলকানন্দা, মৌ-সন্ধ্যা, বেলি, কামিনী, শিউলি ছাড়াও বাগান বিলাসের যে চারাগুলো বপন করে দেয়া হয়েছিল তার মধ্যে বড্ড অবহেলা আর অযত্নে পূর্ব-দক্ষিনে নিভৃতে বেড়ে উঠে অলকানন্দা ফুল গাছটি। সবচেয়ে বেশি যত্ন পেতো গোলাপমাতা। কিন্তু অতি আদরের গোলাপ গাছ কেবল চার বছরে একটি করে চারটি ফুল দিয়েই আচমকা নুইয়ে পড়ল। তার শরীরের অবনতি হল রোজ। সবুজ পাতা লালচে হয়ে গেলো কয়েকদিনেই। তারপর গোলাপমাতাকে নিয়ে সে-কি ব্যস্ততা! বাঁচলো না। অবশেষে মরে গেলো। গোলাপমাতার জায়গাটা শূন্য পরে রইল সেই থেকেই।

সেইবার আচমকা বন্য হল। অতীত ইতিহাসে এ পাড়ায় কখনো বন্যার কথা পূর্বপুরুষেরা বলে যায়নি। ভারী বর্ষণে বিলগুলো ভরে গিয়ে আধাপাকা রাস্তা অবধি জল গড়াতো, এটুকুই লোকমুখে শোনা কথা। কিন্তু আচমকা বন্যা সেইবার মারাত্মকভাবে হানা দিল। অনেক ক্ষতি হল পাড়াগাঁয়ের। অধিকাংশের বাড়িঘর ভেসে গেছে বানের জলে। সেই জলের স্রোতে ভেসে গেছে উঠুনের গাঁদা, মৌ-সন্ধ্যা,বেলি কামিনী,শিউলি এবং বাগান বিলাস ফুল গাছের চারাও।

বানের জল নেমে গেলে উঠুনের কোণে দেখা যায় টিকে থাকার লড়াইয়ে জিতে যাওয়া এক সাহসী অলকানন্দাকে। সবাই ছেড়ে গেলো, সে রয়ে গেল। পুরোনো টিনের ভিত্তির দায়ভার নিয়ে দূর্বল বয়স্ক এক খুঁটিও কি করে যেনো রয়ে গেলো এমন দুর্বিষহ দুর্যোগ মোকাবিলা করে। পূর্বদিকে সামান্য হেলে গেছে। আর সেই হেলে যাওয়া বয়স্ক খুঁটির গাঁ ঘেঁষে মূলটা মাটিচাপাতেই রেখে প্রাণপণ লড়ে গিয়ে নতুন জীবনের সূর্য থেকে খাবার আহরণ করবার ভাগ্য হল অলকানন্দা।
অবজ্ঞা, অবহেলার আঘাতে জর্জরিত হৃদয়ে, ভারাক্রান্ত মনে কবে যেনো লক্ষপাতার জননী হয়ে গেল অলকানন্দা! বছর জুড়ে সেই লক্ষ পাতার পাশাপাশি তার অবজ্ঞার জবাবে হাজার ফুল জন্ম দিল। তবুও অলকানন্দা অবহেলা আর অবজ্ঞা থেকে মুক্তি পেলো না।

অনেকটা বছর অতীত নামক কালের বুকে ছুটে গেলো তড়িৎ বেগে। অলকানন্দা দিনদিন উজ্জীবিত হতে লাগল আর যতদিন যায় অবজ্ঞাকারীর মানুষদেহের চামড়া ঝুলতে লাগলো। অলকানন্দা তার যৌবনের দাপট প্রত্যহ প্রদর্শনে বৃদ্ধদেহের বন্ধু হল নিজ থেকেই।

অগণিত অলকানন্দা ফুল ফুটে আছে। পাতার কালচে সবুজ রং আর ফুলের উজ্জ্বল হলুদ রং-এ সূর্যের আলো ছুঁয়ে দিলেই তীব্র এক চাহনিতে কি যেনো বোঝাতে চায় অলকানন্দা! ছায়া যখন ছুঁয়ে দেয় তখনই শিরোধার্যের মধ্যে দিয়ে নির্মল এক আনুগত্য প্রদর্শন করে! যা ভয়ংকর রকমের সুন্দর।

অলকানন্দের হলুদ আস্তরণে উঠান ছেয়ে গেছে তা বোঝা’ই যায় কিন্তু এক এক করে যে অলকানন্দা গণনা করে প্রহর অতিক্রম করে যাওয়া যাবে তার অবকাশ নেয়। যৌবনকালের সেই চোখের প্রখর দৃষ্টি আজ বড্ড অকেজো হয়ে গেছে। কোথায় সে প্রখরতা!
অথচ আজ এমন দুঃসময়ে অবহেলিত সেই অলকানন্দা’ই বন্ধু হয়েছে!
অলকানন্দের আজ লজ্জা নেই। লজ্জা এই জোড়া চোখের। মোটা কালো ফ্রেমের বেষ্টনীতে ঘেরা কাচের টুকরোটাই আজ চোখের লজ্জা। কাচের টুকরো জোড়া ছাড়া চক্ষুদ্বয় বড্ড অসহায়।
কিন্তু অলকানন্দা কেনো এতো উদার! উত্তম মনের অধিকারী? কি করে সে অতীতে প্রাপ্ত অবহেলা, অবজ্ঞার কষ্ট ভুলে বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে! এই এক অদ্ভুত, বিস্ময়কর হৃদয়ের পরিচয় নয় কী!

জীবন দিবসের সন্ধ্যা নেমে আসে। অলকানন্দা ঘুমায় না। প্রচলিত কথায় আছে, ‘সূর্য ডুবলো, গাছের চোখে ঘুম নেমে এলো’। আর তাদের ঘুমানোর সময়ে তাদের ডালপালা ভাঙতে নেই, কারণে-অকারণে পাতা ছিঁড়তে নেই, এমনকি স্পর্শ করা অনুচিত।
তাহলে এই অলকানন্দা ঘুমায় না কেনো!
হৃদয়ের প্রখর দৃষ্টিতে, অন্তরস্থ অনুভূতি দিয়ে যদি দেখার চেষ্টা করা যায় তাহলে বুঝতে পারা যায় গাছেরা ঘুমিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে এ-ও নিশ্চিত যে অলকানন্দা নির্ঘুম রাত কাটায়।
কেনো সে ঘুমায় না? কি করে তার জেগে থাকার এই বাজে অভ্যাস হল! তবে কি শিশুকালের সেই প্রাপ্ত তিক্ত যন্ত্রণার কারণে রাত জেগে অভিমান ঝেরে ফেলার অভ্যাসিত নির্ঘুম জেগে থাকাটাই চূড়ান্ত হয়ে এসেছে তার জীবনে!
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, অলকানন্দের চোখে কোনো ক্লান্তি নেই! সতেজ, স্বতঃস্ফূর্ত আর বলশালী সুঠামদেহে এক উদ্যমী এবং সাহসী সৈনিকের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যেনো যুদ্ধক্ষেত্রের প্রস্তুতি নিয়ে অপেক্ষারত সহস্র বছর। কোনো অস্ত্র হাতে নয়, টিকে থাকার কঠিন সাহস’ই হল তার ভয়ঙ্করতম ধনুক। যতদূর হোক শিকারকে পরাস্ত করবেই এই যেনো তার শপথ।
তবুও অবজ্ঞাকারীর অন্তিমকালের বন্ধু হয়েই দাঁড়িয়ে আছে অলকানন্দা। আজ কোথায় সে মায়ার গোলাপ! কোথায় বেলি,কামিনী, শিউলিরা! কোথায় আদরের মৌ-সন্ধ্যা আর প্রিয় বাগান বিলাস! স্নেহের, আদরের কেউ আজ পাশে নেই। কারণেঅকারণে সবাই ছেড়ে চলে গেছে এই বুড়োটাকে। শুধু রয়ে গেছে অলকানন্দা। লক্ষ সবুজ পাতার ফাঁকেফাঁকে হাজার হলুদ ফুল নিয়ে টিকে আছে অবহেলা আর অবজ্ঞার প্রত্যুত্তরে। দেখিয়ে দিয়েছে জীবনের অন্তিমকালে সে’ই কতখানি ঘনিষ্ঠ আর সখ্যতা গড়তে পারে।

বৃদ্ধ মনটার অতীত মনে পড়ে যায়। লজ্জা হয়, আফসোস হয়। অলকানন্দের সঙ্গ কাঁপা হাতে গ্রহণ করে, নিজের পাপের প্রায়শিচত্ত করতে চায়। খানিকটা স্বস্তি পায়। নিষ্পাপ যদি একটু স্পর্শ করে যায় তার এমন পাপে ভরা মনে!
অলকানন্দা এখন বৃদ্ধ জোড়া ঠোঁটকেই হাসায়। কথা বলে। গল্প শোনায়। আর অসীম অলস সময়ের একনিষ্ঠ একজন হয়ে পাশেই রয়।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর