ঢাকা ১৮ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:৩৪ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৯
মোহাম্মদ মনির উদ্দিন : বিচারিক অবকাশ যাপনে বাড়িতে এসেছি।বাড়িতে এলে বাল্য ও কৈশোরসাথীদের সাথে আড্ডা দেই।তাঁদের সাথে সময় কাটাতে ভালোলাগে।যেনো পুরোনোরাই আসল ও খাঁঠি।পাঠশালা ও মাধ্যমিক সহপাঠি অধিকাংশই জীবনজীবিকার তাগিদে প্রবাসে।কেউকেউ দেশে থাকলেও এলাকার বাইরে।যে কয়জন এলাকাতে রয়েছে তাঁরা জীবনসংগ্রামে বিলিন। জীবনসংগ্রামী একজন মানুষ আমার বাল্যশিক্ষক মতছিন ভাই।পরিবারের বাইরে বাল্যপাঠ তাঁর কাছ থেকেই। শৈশব-কৈশোরের ঘনিষ্ঠ সারথি।এমন কী জেষ্ঠ্য বন্ধুও।কৈশোর পার হতে না হতেই,সে পরিবারের নিদারূণ হাল ধরতে সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলে যায়।কায়িকশ্রমে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে।দেড়যুগেরও অধিক সময় পার করেছে প্রবাসে।একজীবনের মোক্ষম সময়!বর্তমানে দেশে ব্যবসায় নিয়োজিত।অপেক্ষমাণ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার জন্যে।তাকে বলি,চল কোথা হতে ঘুরে আসি।মুহুর্তেই রাজি।না বলবে,তাঁর বিধানে নেই।অনন্ত আমার বেলায়।একজন ভ্রমণপিপাসু লোক।কিশোর বয়সেই তাঁর সাথে অনেক জায়গায় গিয়েছি।আশপাশ ভ্রমণ করেছি যৌথভাবে।পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে অনেক পাঠগ্রহণ করেছি।প্রাতিষ্ঠানিক পাঠের চেয়ে এর বাইরের পাঠগ্রহণ জরুরি।এই পাঠ আমার জন্যে পথ ও পাথেয়।
সাব্যস্থ হয় বাঁশতলা হকনগর শহিদ স্মৃতিসৌধে যাবো।মোটরবাইক যোগে বাড়ি থেকে রওয়ানা দেই।আমবাড়ী থেকে কাঁটাখালীবাজার হয়ে আজমপুর খেয়াঘাট।অনেক ঢালু ঘাট।বাইক নিয়ে সুরমা নদী পার হওয়া বিরাট ব্যাপার।কষ্টে-সৃষ্টে পার হই।দোয়ারায় চা-নাস্তা শেষে,যাত্রা আবারও শুরু করি।মহব্বতপুর বাজারে থামি।স্বজন আব্দুল হক ভাইয়ের সাথে দেখা করি।কিভাবে বাঁশতলায় স্মৃতিসৌধে যাবো পরামর্শ নেই।চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ ও অবগাহন করে যেতে থাকি।বাংলাবাজার বোগুলা হয়ে বাঁশতলায় পৌঁছি।মন ভরে যায় নৈসর্গিক দৃশ্যে।
গারোপাহাড়ের একেবারে সন্নিকটে বাঁশতলা শহিদ স্মৃতিসৌধ হকনগর।সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার একটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয়স্থান।মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকা।মুক্তিযুদ্ধের সময় এটি পাঁচ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত সাব-সেক্টর হিসেবে ছিল।এই সেক্টরের বেসামরিক রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন আব্দুল হক এমএলএ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন এই হক।তাঁর নামেই হয়েছে ‘হকনগর’।সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার জিয়াপুর গ্রামের আব্দুল হক এমএলএ এর মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর জীবদ্দশায়ই এলাকাবাসী তাঁর নামে ‘হকনগর’ রাখেন।মহান মুক্তিযুদ্ধ সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসাসেবা দেয়া হতো।এখানে হকনগর প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।বর্তমানে এটি হকনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।হকনগর হাসপাতালটি এখন নেই।বিদ্যমান আছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক।পাঁচ নম্বর সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন মেজর মীর শওকত আলী।ক্যাপ্টেন এএস হেলাল উদ্দিন ছিলেন সাব-সেক্টরের কমাণ্ডার।হকনগরের এই শহিদ স্মৃতিসৌধে চৌদ্দজন শহিদের সমাধিসৌধ রয়েছে।হয়তো আরও অনেকেই রয়েছেন অজ্ঞাতে।স্বাধীনতাযুদ্ধে দেশমাতৃকার জন্যে জীবনবাজী রেখে অবিরাম যুদ্ধ করে শহিদ হয়ে,এখানেই শায়িত রয়েছেন বাংলার বীরসেনানীরা।
স্মৃতিসৌধের অনতিদুরে চেলাই নদী।নদীকে ঝর্ণার মতো মনে হয়।’চিক্ চিক্ করে বালু,কোথা নাই কাদা’।ঝর্ণার নির্মল স্বচ্ছ জল।মন কেড়ে নেয়। চারিদিক সবুজের অনাবিল সমাহার।যেন চোখ আটকে যায়।নদীর উপর নির্মিত সুইসগেইট।জল নামছে মনমাতানো শব্দে।সুনিপুণ ছন্দে।অপূর্ব-নয়নাভিরাম দৃশ্য!প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর!ভারতের চেরাপুঞ্জির পাদদেশে মেঘালয় রাজ্যের সবুজ পাহাড়।এই পাহাড় ঘেরা বাঁশতলা।স্মৃতিসৌধের পাশেই ভ্রমণার্থীদের সুবিধার্থে রয়েছে রেস্ট হাউজ।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে বিজয়মঞ্চ।দর্শণকারীরা প্রতিনিয়তই আসছে যাচ্ছে।
স্মৃতিসৌধের কাছাকাছি দুইআড়াইশ বছরের পুরোনো পাহাড়।সহজসরল আদিবাসী গারোদের বসবাস। পাহাড় প্রকৃতির প্রকৃতরূপ অবলোকনে প্রকৃতি প্রেমীরা জড়ো হয়।আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে।ক্ষণিকের জন্যে ক্লান্তি-ক্লেশ ভুলে যায়।এখানে জুমগাঁও গ্রামে বসবাস করে আদিবাসী গারোদের পঁচিশত্রিশটি পরিবার।তাঁরা তৈরী করে নিজেদের ব্যবহার্য হরেকরকম জিনিষপত্র।রয়েছে গারোপাহাড়ে মিশনারি স্কুল,উপাসনালয় ও পাহাড়ের চূড়ায় উঠতে নির্মিত সিঁড়ি।এ স্থান যেনো পর্যটকদের মন কাড়ার মতো মনোরম দর্শনীয়স্থান।
মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক নিদর্শণ,মেঘালয় পাহাড়,আদিবাসী গারোদের গ্রাম,চেলাই নদীর উপর নির্মিত সুইসগেইটে জলের ঝর্ণাধারা অবলোকন ও উপভোগ করে এবার ফেরার পালা।আঁকাবাঁকা পথে মহব্বতপুর বাজারে আসি।স্বজন আব্দুল হক ভাইয়ের বাড়ি টিলাগাঁও যাই।হক ভাই অপেক্ষমাণ ছিলেন।পূর্ব প্রস্তুতি থাকায় এসেই ভোজনপর্ব।পরে রওয়ানা দেই।দোয়ারাবাজার এসে সহপাঠি বন্ধু প্রকৌশলী ফরিদ ও শিক্ষক মদনকে পাই।ফরিদের সাথে সিলেটে মাঝেমধ্যে দেখা ও কথা হয়।কিন্তু মদনের সাথে কমবেশি দেড়যুগ পর সাক্ষাত।কুশল বিনিময় হয়।একসাথে চা পান করি।সন্ধ্যা হয়ে যায়।বিদায় নেই দ্রুত।নদীঘাট এসে খেয়াপার হই।ঘন অন্ধকার চারদিক।মতছিন ভাই বাইক চালাতে থাকে।পিছনে বসে কথা বলছি।কথা শেষ হয় না।বাড়ি পৌঁছি।তবুও কথা শেষ হয় না।
লেখক : আইনজীবি
__________________________________
১৭ডিসেম্বর,২০১৯॥আমবাড়ী,সুনামগঞ্জ
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by syltech