ঢাকা ১৮ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৪ঠা মাঘ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৩২ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৯
ডেস্ক প্রতিবেদন : কাছের বড় শক্তি ভারত ও চীন—দুই দেশকেই আস্থায় রেখে চলছে বাংলাদেশ। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ও অংশীদারিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ‘স্ট্র্যাটেজিক’ মাত্রায় উন্নীত করেছে। অন্যদিকে নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে তারা বলছে ‘বিয়ন্ড স্ট্র্যাটেজিক’ (সুদূরপ্রসারী সার্বিক লক্ষ্যমুখীর চেয়েও ওপরে)।
সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার মতে, চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সময়ের চাহিদা অনুযায়ী। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশ স্বাধীন করতে প্রায় ১৭ হাজার ভারতীয় সেনা শহীদ হয়েছেন। দুই দেশের জনগণ ও সেনা সদস্যরা মিলে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। ইতিহাসের কঠিনতম সময়ে রক্তের বন্ধনে গড়া এ সম্পর্কের সঙ্গে অন্য কোনো সম্পর্কের তুলনা হতে পারে না।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক সম্পর্কও বেশ এগিয়েছে। ওই দুই দেশের মধ্যে আবার প্রতিযোগিতা এবং বিভিন্ন বিষয়ে উদ্বেগ আছে। অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশের সমরাস্ত্রের বড় জোগানদাতা চীন। অন্যদিকে ২০১৭ সালে বাংলাদেশকে সামরিক সরঞ্জাম কিনতে ভারত ৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশ সাবমেরিন কেনার পর বঙ্গোপসাগরে এর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়। সেগুলোর অনেকাংশেই ছিল ভারতের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কায় উদ্বেগের সুর। গত অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরকালে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ‘রাডার সিস্টেম’ বসানোর বিষয়ে ভারতের সঙ্গে একটি এমওইউ সই হয়। ওই এমওইউ অনুযায়ী, ভারত বাংলাদেশকে রাডার সিস্টেম সরবরাহ করবে।
ভারতের কাছ থেকে রাডার নিয়ে বসালে চীনের সঙ্গে সম্পর্কে কী প্রভাব পড়বে তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে পর্যবেক্ষণ ও জল্পনা-কল্পনা আছে। এ ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ কিভাবে ভারসাম্য বজায় রাখছে জানতে চাইলে সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা চীনের কাছ থেকে সাবমেরিন, ভারতের কাছ থেকে রাডার নিয়েছি। এ নিয়ে অন্য পক্ষের সম্ভাব্য উদ্বেগগুলো আগেই নিরসন করেছি। অর্থাৎ অন্য পক্ষের জন্য উদ্বেগের কারণ হতে পারে এমন বিষয়গুলো আমরা আগেই দূর করেছি।’
রাডার বা সাবমেরিন কেনার কারণ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আপনারা স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক চাইবেন কিন্তু প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চাইবেন না, তাহলে স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক কিভাবে হবে?’
২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে চীনা পরিকল্পনা ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই)’ যোগ দেয় বাংলাদেশ। সেটির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, চীন ও ভারতের নিজস্ব ও পরস্পরকে ঘিরে থাকা উদ্বেগ বাংলাদেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারে। এযাবৎ বাংলাদেশ সফলভাবেই তাদের উদ্বেগ বা স্পর্শকাতর বিষয়গুলো সামাল দিতে পেরেছে। যেমন ‘এক চীন’ নীতি এবং তাইওয়ান নিয়ে অবস্থান চীনের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
জানা গেছে, ২০০৪ সালে তাইওয়ান বাংলাদেশে অফিস খোলার পর চীনের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দিয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যেই ওই অফিস বন্ধ করা হয়। দেরিতে হলেও ‘ভুল’ শুধরেছে বাংলাদেশ।
সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা বাংলাদেশের কূটনীতিতে আরেকটি ‘বড় ভুল’ হিসেবে দেখছেন ভারত-মিয়ানমার গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে তৎকালীন সরকারের নেতিবাচক মনোভাবকে। বাংলাদেশ তার ভূখণ্ড দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন নেওয়ার সুযোগ নিতে রাজি না হওয়ায় ২০০৪-০৫ সালের দিকে সেই উদ্যোগ স্থগিত করে ভারত ও মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমার সরকার এরপর আরো অন্তত দুই বছর অপেক্ষা করেছে। পরে চীনের সঙ্গে গ্যাস পাইপলাইন প্রতিষ্ঠায় রাজি হয় মিয়ানমার। ওই পাইপলাইনের শুরু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় শহর কিয়াউকপু থেকে এবং শেষ চীনের ইউনান প্রদেশে।
সংশ্লিষ্ট এক কূটনীতিক বলেছেন, ২০০৩-০৪ সালের দিকে বাংলাদেশ সরকার ‘দ্য সুয়ে ন্যাচারাল গ্যাসলাইন প্রজেক্ট’ নামে ত্রিদেশীয় (মিয়ানমার-বাংলাদেশ-ভারত) ওই গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের গুরুত্বই বুঝতে পারেনি। কারণ এটি শুধু পাইপলাইন প্রকল্প নয়, এটি ভূ-রাজনৈতিক একটি উদ্যোগ। ওই প্রকল্প হলে একদিকে বাংলাদেশের যেমন মিয়ানমারের গ্যাস পাওয়ার সুযোগ থাকত তেমনি ত্রিদেশীয় স্ট্র্যাটেজিক সমঝোতার সুযোগ সৃষ্টি হতো। এর ফলে এই অঞ্চলের, বিশেষ করে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আরো অনেক বাড়ত।
ওই কূটনীতিক বলেন, চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের গ্যাস পাইপলাইন প্রতিষ্ঠার পর রাখাইনের গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা সংকটে মিয়ানমার সরকারের প্রতি চীনের যে সমর্থন তাতেও বড় ভূমিকা রেখেছে ওই গ্যাস পাইপলাইনের মতো ভূ-রাজনৈতিক প্রকল্প। বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের আপত্তির কারণে ভারত ও মিয়ানমারের উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। আর এ সুযোগে চীন নিজের জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থার নতুন উদ্যোগ প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করেছে।
বাংলাদেশের কয়েকজন কূটনীতিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান সরকারের নীতি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা নয়; বরং এই অঞ্চলের সবাইকে নিয়ে সহযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে চলা। বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের জন্য স্পর্শকাতর ও উদ্বেগের বিষয়গুলোর ব্যাপারে সজাগ। এ কারণে এখন ভারত ও চীন—দুই দেশই তার বন্ধু তালিকায় বাংলাদেশকে রাখে।
সম্পাদক : জে.এ কাজল খান
স্বত্ত্ব: দৈনিক বিজয়ের কণ্ঠ (প্রিন্ট ভার্সন)
০১৭১৮৩২৩২৩৯
Design and developed by syltech