করোনায় তছনছ বিশ্ব অর্থনীতি

প্রকাশিত: ৬:৫৩ অপরাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০২০

করোনায় তছনছ বিশ্ব অর্থনীতি

ডেস্ক প্রতিবেদন : করোনাভাইরাসের প্রভাবে তছনছ হয়ে পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) জানিয়েছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে করোনার প্রভাবে বৈশ্বিক উৎপাদন কমেছে ৫ হাজার কোটি ডলার। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মঝারি শিল্প। বিশ্বের উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো ১১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের ক্ষতির মুখে পড়েছে। চীনের রফতানিতে ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। কমেছে ১৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজস্ব আহরণ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সসহ ইউরোপের অনেক দেশেই করোনার ধাক্কায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে অর্থনীতি ও বাণিজ্য।
করোনার বৈশ্বিক প্রভাবের বাইরে নেই বাংলাদেশও। ইতোমধ্যেই তৈরি পোশাক শিল্পের এক্সেসরিজ, সুতা, সুইং থ্রেড, পেপার, প্লাস্টিক সামগ্রী থেকে শুরু করে সব ধরনের কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশ। একই সঙ্গে ডায়িং খরচও বেড়েছে অস্বাভাবিক। এভাবে সব কিছুর দাম বৃদ্ধি শেষ করে দিচ্ছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয় তাহলে আরও বড় ক্ষতি হয়ে যাবে দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক শিল্পে। দেশের বাণিজ্যে বিশেষ করে রফতানি খাতে করোনাভাইরাসের ক্ষয়ক্ষতির কথা বলতে গিয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি রুবানা হক এ চিত্র তুলে ধরেন।
এসব কাঁচামালের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ ভাগই আসে চীন থেকে। করোনাভাইরাস চীনের অর্থনীতি ও বাণিজ্যকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশের বাণিজ্যও এলেমোলো হয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই চীন থেকে পণ্যবাহী জাহাজ আসা অর্ধেকে নেমে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের নভেম্বরে চীন থেকে পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে ১৪টি, ডিসেম্বরে আসে ১২টি এবং চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আসে ১৫টি। অথচ ফেব্রুয়ারি মাসে চীনা পণ্যবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছে মাত্র ৮টি। বন্দরের এই পরিসংখ্যান দেখেই বোঝা যায়, চীন থেকে পণ্য আসা কী পরিমাণে কমে গেছে। আর এর প্রভাবে দেশের বাণিজ্যে করোনার ক্ষতি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে প্রায় সব দেশের অর্থনীতিতে। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে চীনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের আমদানি-রফতানি। আইএমএফ জানায়, ফেব্রুয়ারি মাসে বৈশ্বিক উৎপাদন কমেছে অন্তত ৫ হাজার কোটি ডলারের। কমেছে প্রায় সব দেশের রফতানি আয়। অর্থনৈতিক মন্দার বার্তা এসেছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো প্রযুক্তি খাতে শীর্ষে থাকা দেশগুলো থেকে।
হুন্দাই রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক জো উন বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি পুরোটাই রফতানিনির্ভর। বিশ^ব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দেশটিতে প্রতিদিনই বাড়ছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের লোকসানের পরিমাণ। দেরিতে হলেও অর্থনীতিতে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কথা স্বীকার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতে পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। পরিস্থিতি মোকাবেলায়, ৮৩০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় মার্কিন সিনেট।
এরই মধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ^ পুঁজিবাজারে ধস নেমেছে। যাত্রী পরিবহনকারী উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো ১১ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ক্ষতির মুখে পড়তে পারে বলেÑ উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর জোট ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। চীনের অর্থনীতির দুর্দশার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে।
এদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মহামারী আকার ধারণ করায় চীনের রফতানি ও আমদানি দুটোই কমেছে। করোনার কারণে চীনের ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য রফতানি বন্ধ করতে বা সীমিত করতে বাধ্য হয়েছে। গত বছরের প্রথম দুই মাসের তুলনায় চলতি বছরের এ সময়ে চীনে ১৭ দশমিক ২ শতাংশ পণ্য রফতানি কম হয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এত বড় বিপর্যয় আর হয়নি। চীনের শুল্ক বিভাগের দেওয়া তথ্য মতে, গত দুই মাসে চীনের আমদানি ৪ শতাংশ কমেছে। গত শনিবার বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমবারের মতো জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের বাণিজ্য চিত্র প্রকাশ করেছে চীন। তার আলোকেই প্রতিবেদনটি করেছে এএফপি।
করোনার প্রভাব নিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক সময়ের আলোকে বলেন, করোনার কারণে দেশের অনেক রফতানি খাত হয়তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। কারণ এ শিল্পের এক্সেসরিজ থেকে শুরু করে অনেক কাঁচামাল প্রায় পুরোপুরি চীননির্ভর। করোনার কারণে এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে ৫০ শতাংশ। এমনিতেই পোশাক শিল্প আগে থেকেই নানা কারণে ধুঁকছে। নতুন করে করোনা সঙ্কট আমাদের শেষ করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে করোনার প্রভাব হয়তো এখন বেশি চোখে পড়ছে না, কিন্তু আগামী ২-৩ মাসের মধ্যে এ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে না এলে কানো কোনো খাতে উৎপাদন নেমে আসবে শূন্যের কোঠায়। কিছু খাত রয়েছে চরম হুমকির মুখে।
সঙ্কটের সুযোগ নিয়েছে চীন থেকে যারা এসব পণ্য আমদানি করে সেসব প্রতিষ্ঠান। এই সুযোগে তারা চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ এসব পণ্য ৪ থেকে ৫ মাস আগে আমদানি করা। তখন তো করনোর প্রভাব ছিল না। নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের রঙ, সুতা এবং ডাইস কেমিক্যালসহ অন্যান্য কাঁচামালের ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যেই কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাছাড়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট, সোডারও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে আমদানিকারকরা। এসব পণ্যের এখন দেশে যে স্টক রয়েছে তা দিয়ে আগামী ৪ থেকে ৫ মাস চলার কথা, এখনই কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়েছে। অধিকাংশ পণ্যেরই ২০-৩০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে, কোনোটার ৫০ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। যেমন সল্ট, বিশ^বাজারে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্টের দাম কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ১৭ টাকার মধ্যেই থাকে, কিন্তু এখন তারা দাম বাড়িয়ে গত সপ্তাহ থেকে ২৪ টাকা হয়ে গেছে। আর কয়েক দিন পর হয়তো ৩০ টাকা হয়ে যাবে। এখন অসাধু ব্যবসায়ীরা এ ধরনের কারসাজি শুরু করেছে।
গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং খাতে বার্ষিক চার বিলিয়ন ডলারের কাঁচামাল দরকার হয়। যার ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ চীন থেকে আসে। কাঁচামালের প্রাপ্তি বিঘ্নিত হওয়ায় এ খাতে প্রায় এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৫০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
চীন থেকে কসমেটিকস অ্যান্ড টয়লেট্রিস খাতে প্রতি মাসে আমদানির পরিমাণ ২০০ কন্টেইনারেরও বেশি, যার মূল্য প্রায় ৭৫ কোটি টাকা। বর্তমানে চীন থেকে এসব পণ্য আমদানি ও জাহাজীকরণ সম্পূর্ণ বন্ধ আছে।
গত ২৫ জানুয়ারি থেকে চীনে কাঁকড়া ও কুঁচে রফতানি বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ কাঁকড়া ও কুঁচে চীনে রফতানি হয়। স্থানীয় বাজারে এসব পণ্যের কোনো চাহিদা নেই। তাই পণ্যগুলো রফতানি করতে না পারায় গত এক মাসে প্রায় ২০০ কোটি টাকার জীবন্ত কাঁকড়া ও কুঁচে মারা গেছে। মজুদ করা পণ্য রফতানি করতে না পারলে ক্ষতির পরিমাণ ৩৫০ থেকে ৪০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
নিট খাতের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ কাঁচামাল চীন থেকে আমদানি হয়। এ ছাড়া নিট ও ডায়িং কেমিক্যাল এবং এক্সেসরিজের ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ আমদানি হয় চীন থেকে। ইতোমধ্যেই এ খাত ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর