তীরশিলং জুয়ার মহোৎসব ‘যদি একবার লাইগ্যা যায়’

প্রকাশিত: ১:৩৪ অপরাহ্ণ, জুলাই ২২, ২০১৯

তীরশিলং জুয়ার মহোৎসব ‘যদি একবার লাইগ্যা যায়’

খলিলুর রহমান :::: 
জুয়া ছিল কার্ড দিয়ে গুটি দিয়ে বা লটারীর কাগুজে টোকেন দিয়ে। এখন আর সে যুগ নেই। এখন ডিজিটাল যুগ, জুয়া-লটারীও ডিজিটাল। ডিজিটাল জুয়া ও লটারীতে এখন ছেয়ে গেছে সিলেট। ভারতের মেঘালয়া রাজ্যের রাজধানী শিলং ও অসম রা জ্যের রাজধানী গোয়া হাটি থেকে ১৯৯০ সালে শুরু এ জুয়ার আসর। আজ থেকে প্রায় ২৮ বছর আগে ‘তীর কাউন্টার’ নামে শুরু হওয়া লটারি এখন ‘তীরশিলং লটারী’ নামে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেছে। ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে এ তীর খেলা এখন সিলেটের সর্বত্র হয়ে উঠেছে জুয়ার মহোৎসব। সিলেট মেট্রোসিটির দক্ষিণ সুরমা থেকে উত্তর সুরমার প্রায় অর্ধশত পয়েন্টে বসে তীর জুয়ার আসর। এসব আসর থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাবাহিনীর সদস্য ও সাংবাদিক নামধারীরা বখরাও আদায় করে থাকেন। মাঝে মধ্যে লেনদেনে ব্যতিক্রম ঘটলে লোকদেখানো অভিযান ও গ্রেপ্তারে ঘটনাও ঘটে। মূলত এই জুয়ার আসরগুলো নিয়ন্ত্রন করেন বিভিন্ন পাড়ার প্রভাবশালী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী ও ক্ষমতাধর ছাত্রনেতারা।
শুরুর দিকে বাংলাদেশে এই খেলার প্রচলন ছিল কেবল ভারতের কোলঘেঁষা সিলেটের সীমান্তবর্তী কয়েকটি এলাকার মানুষদের মধ্যে। সরাসরি সীমান্তে বসেই টাকার বিনিময়ে খেলায় অংশ নিতেন কিছু মানুষ। এরপর ধীরে ধীরে এই খেলা ছড়িয়ে পড়ে সিলেটের বিভিন্ন প্রান্তে।
ভারত থেকে শিলংয়ের জুয়াড়িরা বাংলাদেশে তাদের এজেন্ট নিয়োগ করে দেয়। এতে বাড়তে থাকে সাধারণ ক্রেতার সংখ্যা। ইন্টারনেটে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জুয়া খেলার সুযোগে সাধারণ মানুষেরা এতে যুক্ত হতে শুরু করে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত নম্বর বিক্রয় করা হয় যেকোনও অংকের টাকায়। যত মূল্যে বিক্রি হবে, তার ৭০ গুণ লাভ দেওয়া হবে বিজয়ী নম্বরের গ্রাহককে। অর্থাৎ ১ টাকায় পাওয়া যাবে ৭০ টাকা। প্রথম দিকে সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী জাফলং এলাকায় খেলাটির প্রচলন হয়। স্থানীয় ভাষায় টুকা খেলা, নম্বর খেলা, বোটকা খেলা, ভাগ্য পরীক্ষা খেলা, ডিজিটাল নম্বর খেলা ইত্যাদি নামেও পরিচিত ছিল জুয়াটি।‘তীর খেলা সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে। দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে নম্বর কিনে আসতে হয়। সপ্তাহে ছয় দিন খেলাটি পরিচালিত হয়। ভারতের ছুটির দিন রোববার খেলাটি হয় না।
তিন স্তরের লোকদের মাধ্যমে তীরশিলং খেলাটি হয়। দিনে দু’বার ড্র হয়। একবার বিকাল সাড়ে ৪টায়, দ্বিতীয় ড্র হয় সাড়ে ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে। এতে ভারতের শিলং থেকে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইটে প্রতিদিনের শুরুতেই অনেকগুলো কমন নম্বর দেওয়া হয়। এই নম্বরগুলোকে কেন্দ্র করেই সারাদিন ছুটে বেড়ান তীরশিলং খেলতে আগ্রহীরা।’
নির্দিষ্ট এজেন্টরা মুহুরীর (সংগ্রাহকের) মাধ্যমে গ্রাহক সংগ্রহ করে। মুহুরীর থ্রো ছাড়া কোনও ব্যক্তিই সরাসরি তীরশিলংয়ে অংশ নিতে পারে না। এক্ষেত্রে যেটি দাঁড়ায়, প্রথমে এজেন্ট, এরপর মুহুরী, এরপর গ্রাহক।
এ তিন স্তরের বাইরে প্রথম গ্রুপটি ভারতের শিলং থেকে অনলাইনে জুয়াটি ছাড়ে। এরপর একটি অংশ এই জুয়াটি নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশে। যারা সিলেটে জুয়া থেকে আয় করা টাকা সংগ্রহ করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, যেহেতু গ্রাহকের সরাসরি ওয়েবসাইটে গিয়ে তীরশিলং খেলার সুযোগ কম, সেহেতু প্রথমে নির্দিষ্ট সংখ্যার বিপরীতে গ্রাহককে টোকেনের বিনিময়ে খেলায় অংশ নিতে হয়। এই টোকেন কেনায় একটি ফাঁক রয়েছে। এজেন্টরা নিজেরাই ওয়েবসাইটে নির্দিষ্ট কতগুলো সংখ্যার ওপর বাজি ধরে। সেই বাজির ওপর ভিত্তি করে যে সংখ্যাগুলোর ওপর বাজি আসে, ভারতের শিলংয়ে যোগাযোগ করে পেমেন্ট করে রেজাল্ট আনানো হয় অন্য নম্বরে। পরে যাদের বাজির দর কম, সে গ্রাহকদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।
জাফলং বাজারের এক পান ব্যবসায়ী জানান, শিলং বাজারে মামার বাজার নামে একটি স্থানে আছে। সেখানে রহস্যজনক ম্যানেজার আছে একজন। তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তার দাবি, এই ম্যানেজারের সঙ্গে বিশ্বস্ত কেউ ছাড়া সাক্ষাৎ করতে পারে না। তার সঙ্গে থাকে কয়েকজন এজেন্ট। এই এজেন্টদের সঙ্গে সাক্ষাৎ মিলে কেবল বিশেষ কয়েকজন খেলোয়াড় বা গ্রাহকের।
জাফলংয়ের ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ স্টোরের মালিক জামাল বলেন, জাফলংয়ে ১০-১২ বছর ধরে এ জুয়া চলে আসছে। সম্প্রতি এই খেলাটি সম্পর্কে জানাজানি হয়। বছর দুয়েক ধরে এতে অনেক মানুষ জড়িয়ে পড়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
জুয়া খেলায় অংশ নেওয়া গ্রাহকদের সম্পর্কে এক দোকান মালিক জানান, অনেকে একটিমাত্র সংখ্যায় বাজি ধরে। আবার অনেকে সমপরিমাণ টাকায় টানা ১০টি সংখ্যার ওপরে বাজি ধরে। টাকার হার এক টাকায় ৭০ টাকা পাওয়া যায়। কেউ কেউ ১৫ হাজার পর্যন্ত বাজি ধরে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, পরদিনের জুয়া ধরতে আগের দিন রাত থেকে সিরিয়াল দেওয়া শুরু হয়। এভাবে দিনে সর্বোচ্চ একটি নম্বরের কিছুসংখ্যক মানুষ বিজয়ী হয়। আর বাকি সব নম্বরের টাকা এজেন্টরা নিয়ে যায়।স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ধারণা করা হচ্ছে, পুরো সিলেটে দিনে প্রায় ৮০ লাখ থেকে এক কোটি টাকার তীরশিলং বাজি ধরা হয়। কোনোদিন টাকার পরিমাণ আরও বেশি হয় বলে জানান অনেকে। আর এর মধ্যে কেবল কিছুসংখ্যক মানুষই বিজয়ী হয়, বাকিরা নিজেদের লগ্নিকৃত টাকা হারিয়ে দিনের পর দিন জুয়ায় ব্যস্ত থাকে এই আশায় যে, ‘যদি একবার লাইগ্যা যায়’।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর