আসাদ মনি :: ৭১ এর গেরিলা যুদ্ধা আব্দুল কাদির। দেশ প্রেমে নিজেকে আত্মদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনেন। ২২ বছর বয়সি আব্দুল কাদির পরিবারকে না বলেই সে সময় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ভারতের মেঘালয়ে পাড়ি জমান। ছোট বেলা থেকেই শনির হাওর, মাটিয়ান হাওর ও টাঙ্গুয়ার হাওরের বৈরী পরিবেশ তাকে দৃঢ় মনোবল ও লড়াকু করে গড়ে তুলে। টেনিং শেষে হাওরের বৈরী আবহাওয়াকে কাবু করে অসংখ্য সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণের মধ্য দিয়ে নিজের বীরত্বকে প্রমাণ করেন তিনি। দিন ব্যাপি চলা অনেক যুদ্ধে লড়াই করেও শত্রুকে ঘায়েল করতে পিছু হঠেন নি তিনি।
৭০’র নির্বাচনে পর ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আইয়ূব সরকারের টালবাহানায় অনেকটা ক্ষোভের সঞ্চার করে আব্দুল কাদিরকে। চলে এলো ১৯৭১ সাল। তিনি বড়ছড়া (টেকেরঘাট) কোম্পানিতে চাকুরী করতেন তখন। লোকমুখে শুনেছেন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। সে ভাষণ থেকে স্বাধীনতার ডাক আসতে পারে। শুনলেন বঙ্গবন্ধু সেই অগ্নিঝড়া মার্চের কবিতা- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম.. তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মুকাবিলা করতে হবে.. জয় বাংলা’।
.
মার্চ মাসের শেষের দিকেই সবার মাঝে এক উৎকন্ঠার ভাব দেখলেন কাদির। সবাই বলাবলি করতে শুনলেন ঢাকায় নাকি মিলিটারি এসেছে। ২৫ শে মার্চ রাতে হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুকে রাতেই গ্রেফাতার করেছে মিলিটারি। সকাল বেলা রাস্তায় অসংখ্য মানুষকে মরে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ নাকি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
এদিকে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। সে কথা শুনে আব্দুল কাদিরের মধ্যে এক শক্তি সঞ্চার হয়। যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন তিনি।
.
বড়ছড়া কোম্পানিতে (ট্যাকেরঘাট চুনাপাথর খনি প্রকল্প) চাকরী করতেন তখন। পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে চাকরী থেকে সরাসরি মেঘালয়ে চলে যান টেনিংয়ের জন্য। মেঘালয়ের দুর্গম পথ পারি দিয়ে পৌছান তারা এ.কে ১ এ। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তৎকালিন এমপি আব্দুজ জহুরের পরামর্শ নিয়ে ৩৫ জন টেনিংয়ে অংশগ্রহণ করেন। ২১ দিনের টেনিং শেষ করে বড়ছড়া ক্যাম্পে ফিরে আসেন সবাই।
এদিকে বাড়ির ছোট ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেছে সে খবর চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এজন্য তার পরিবারকে এলাকা ছাড়তে হয়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তার পরিবারকে মাতাবপুর সহ বিভিন্ন গ্রামের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে লুকিয়ে থাকতে হয়।
বড়ছড়া ক্যাম্পে থেকে ছোট ছোট দলে ভাগ করে পাঠানো হতো বিভিন্ন অপারেশনে। আব্দুল কাদির সে ক্যাম্পে ছিলেন। ক্যাম্প থেকে রাতের আধাঁরে ছোট নৌকা করে শত্রুর শিবিরে আক্রমণ করতেন তারা। তাহিরপুর ছাড়াও এসময় দিরাই, শাল্লা, জগন্নাথপুর, ছাতক, জামালগঞ্জ পাঠানো হতো তাদের। সে সব এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হতেন।
.
ঠাকুরহাঠিতে সম্মুখ যুদ্ধ
এরকম কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধের বর্ণনা জানা যায়। আব্দুল কাদির ও তার সহযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর সাথে তাহিরপুর সদরের ঠাকুরহাঠিতে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হন। সারাদিন আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণ চলে । আশেপাশের এলাকার মানুষ তখন ঘর ছাড়া হয়েছেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে তাঁর সহযোদ্ধা কাশেমের শরীরে গুলি লাগে। জামালগঞ্জের কাশেম মুহূর্তের মধ্যেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এছাড়াও অনেকে আহত হন তখন।
.
সুলেমানপুরে সম্মুখ লড়াই
তখন কার্তিক মাসের একদিনে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটি গেঁড়েছিলো বর্তমান দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের নিচিনপুর গ্রামে। আব্দুল কাদির সহ ৬০-৭০ জনের গেরিলা দলটি ছিলো সুলেমানপুর। সকাল থেকে শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে লড়াই চলে। এই যুদ্ধের পরের দিনই তাহিরপুর স্বাধীন হয়।
আব্দুল কাদিরের কাছ থেকে জানা যায়, যুদ্ধে যারা আহত হতেন তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বড়ছড়া ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হত। বড়ছড়া ক্যাম্পেই হতাহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হতো।
বীর মুক্তিযুদ্ধা আব্দুল কাদির’র বয়স বর্তমানে ৭০ বছর। জীবন সায়াহ্নে আব্দুল কাদির ভাবেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ডাকে নিজের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ জীবনকে বাজী রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা হয়ত চলে যাবেন কিন্তু নতুন প্রজন্মের কাছে সেসব ইতিহাস জানাতে হবে।