মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি সুনামগঞ্জ কলেজের ভিপি হুমায়ূন কবীর চৌধুরীর নাম

প্রকাশিত: ৩:১২ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৫, ২০২০

মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হয়নি সুনামগঞ্জ কলেজের ভিপি হুমায়ূন কবীর চৌধুরীর নাম

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি : সুনামগঞ্জ হচ্ছে পঞ্চরত্ন বাউলের দেশ। পঞ্চরত্নরা হচ্ছেন বৈষ্ণব কবি রাধারমন দত্ত, মরমী কবি হাছন রাজা, গানের সম্রাট বাউল কামাল পাশা, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম ও জ্ঞানের সাগর দূর্বীণ শাহ। উক্ত পঞ্চরত্নের ২ পরিবারের সাথে সম্পর্ক রয়েছে সুনামগঞ্জ কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা ও ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাবেক ভিপি হুমায়ূন কবীর চৌধুরীর।
তিনি পৈত্রিক সূত্রে মরমী কবি হাছন রাজার প্রৌপুত্র ও মাতৃসূত্রে গানের সম্রাট বাউল কামাল পাশার ভাগ্নির পুত্র। হুমায়ূন কবির চৌধুরী ১৯৫২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ পৌরসভার তেঘরিয়া আবাসিক এলাকায় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম বদরুদজাহা চৌধুরী মাতামৃত সাফিয়া খাতুন।
তাঁর দাদা দেওয়ান আখলাকুর রাজা চৌধুরী দিলকুশ মিয়া জমিদার হাছন রাজার ছেলে। ৫ ভাই ও ৩ বোনের মধ্যে পরিবারের ২য় ভ্রাতা তিনি। তাঁর জেষ্ট ভ্রাতা আবুল মহসীন চৌধুরী ও আবুল বশর চৌধুরী তার ন্যায় ইতিপূর্বে লোকান্তরিত হয়েছেন। চতুর্থ ভ্রাতা খয়রুল কবির চৌধুরী একজন আইনজীবি সহকারী ও কনিষ্ট ভ্রাতা পুলক কবির চৌধুরী ব্যবসায়ী শ্রমজীবি। বোনদের মধ্যে তাহমিনা কবির চৌধুরী মিনা, মাহিনা কবির চৌধুরী হেনা ও রুখশানা কবির চৌধুরী রুখশানা বৈবাহিক সূত্রে মামার বাড়ী ভাটিপাড়ায় গৃহিনী হিসেবে সংসার পরিচালনা করছেন।
হুমায়ূন কবির চৌধুরীর স্ত্রীর নাম নার্গিস আক্তার চৌধুরী বেবী একজন সুগৃহিনী। তিনি মৃত্যুর আগে রেখে গেছেন ৩ পুত্র ও ১ কন্যা। সন্তানদের মধ্যে মাহবুবুল কবির চৌধুরী সৈকত জাপান টব্যাকো কোম্পানীতে চাকুরী করে। মাহফুজুল কবির চৌধুরী কপোত চাকুরী করে আবুল খায়ের কোম্পানীতে।

মাজহারুল কবির চৌধুরী শপথ প্রাইভেট কাজে ব্যস্ত। তাঁর একমাত্র কন্যা উম্মে সালমা আক্তার শ্রাবণী সিলেট মদনমোহন কলেজে বিএ অনার্স ক্লাসে অধ্যয়নরত। সন্তানদের সকলেই বিএ ও অনার্স পাশ করেছে। ভাটিপাড়া নিবাসী বিশিষ্ট পঞ্চায়েত সালিশী মরহুম আব্দুল খালিক চৌধুরী তাঁর নানা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সুচনালগ্নে ২৭ মার্চ পাকবাহিনী সুনামগঞ্জ দখল করলে ২৯ মার্চ পর্যন্ত এই বাহিনীকে সুনামগঞ্জ থেকে বিতাড়িত করে শহরকে শত্রুমুক্ত করার ছাত্র ও গণ আন্দোলনে তিনিই মূল নেতৃত্ব দেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি সুনামগঞ্জ কলেজের ভিপি ও শীর্ষ ছাত্রনেতা ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপের নেতা হিসেবে হুমায়ূন কবীর চৌধুরী ও জামিলুল হক চৌধুরী প্যানেল নিয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে পূর্ন প্যানেল সহকারে তারা ভিপি জিএসসহ অন্যান্য পদে নির্বাচিত হন। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি ৫নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাবসেক্টরের বিভিন্ন রনাঙ্গনে কৃতিত্বের সাথে মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি যোগ দেন জাতীয়তাবাদী দল বিএনপিতে। বিভিন্ন সময়ে দলটির জেলা কমিটিতে গুরুত্বপূর্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সুনামগঞ্জ জেলা ইউনিট কমান্ডের উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালন করেন। সুনামগঞ্জ দখলকারী পাক বাহিনীকে ৩ দিনের ব্যবধানে পরাস্ত করে শহরকে শত্রুমুক্ত করার গৌরবোজ্জল রেকর্ড সৃষ্টি ও টেকেরঘাট সাবসেক্টরের রণাঙ্গনে যুদ্ধ করলেও রাজনৈতিক রোষানলের শিকার হওয়ার কারণে তাঁর নামটি এখনও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি।
একাধিকবার আবেদন নিবেদন করার পর ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর মঙ্গলবার সুনামগঞ্জ পৌরসভার বড়পাড়া আবাসিক এলাকার শ্যামলী-২ নং বাসভবনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানীর অসহায় পরিবারটি মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতা প্রাপ্তিসহ সরকারের অনেক সুবিধাদি প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
সিলেট শহরের সুবিদবাজারস্থ কলাপাড়া এলাকায় হযরত শাহ রুমি (রহঃ) এর মাজার সংলগ্ন একটি ভাড়াটে বাড়ীতে অবস্থান করছে তার অসহায় পরিবারবর্গ ও সন্তান সন্তুতিরা। টেকেরঘাট সাবসেক্টরের মজিদ কোম্পানীরসহ অধিনায়ক দিরাই উপজেলার মজলিশপুর নিবাসী যোদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এন.এম মাহমুদুর রসুল বলেন,ছাত্রনেতা হুমায়ূন কবীর চৌধুরী আমাদের সাথেই রনাঙ্গনে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করেছেন। তাঁর নামটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি জেনে আমার অতি খারাপ লাগছে।

জেলা ও উপজেলা কমান্ডার হিসেবে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে আমি অনুরোধ করবো তারা যেন নিজ দায়িত্বে হুমায়ূন কবীর চৌধুরীর নামটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তভুক্ত করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের আহবায়ক সাবেক পিপি এডভোকেট বজলুল মজিদ চৌধুরী খসরু বলেন,আমি ছাড়াও যারাই সুনামগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেছেন তাদের সকলের লেখাতেই মুক্তি সংগ্রামের ছাত্র ও গণ আন্দোলনের নায়ক হিসেবে হুমায়ূন কবীর চৌধুরীর নামটি লিপিবদ্ধ আছে।
আমরা চাই সরকারও যেন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাঁর নামটি সেইভাবেই লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহন করেন। হুমায়ূন কবীর চৌধুরীর খালাতো ভাই ভাটিপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেন, আপাদমস্তক একজন সৎ শিক্ষিত মার্জিত বিনয়ী ভদ্র অমায়িক মানুষ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ূন কবীর। দেশকে তিনি স্বাধীনতা দিলেও সমাজ থাকে বঞ্চিত করেছে এ লজ্জা আমাদের সকল রাজনীতিবিদদের।
আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী জাহান বলেন,মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান জেলা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন জেলা প্রশাসক। আমরা চাই জেলা প্রশাসন অন্ততপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাঁর নামটি লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা গ্রহন করুক। হুমায়ূন কবীর চৌধুরীর সন্তানরা যথাক্রমে মাহবুবুল কবির চৌধুরী সৈকত,মাহফুজুল কবির চৌধুরী কপোত ও মাজহারুল কবির চৌধুরী শপথ বলেন, আমাদের পিতা মুক্তিযুদ্ধ করার পরও মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাননি,সন্তান হিসেবে এই কষ্ট ও দু:খের কথা আমরা জীবনেও ভূলতে পারবোনা।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবী অন্ততপক্ষে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় আমাদের পিতার নামটি তালিকাভূক্ত করে দিন। দৈনিক সুনামগঞ্জ প্রতিদিন পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশক আহমদুজ্জামান চৌধুরী হাসান বলেন,আসন্ন প্লাটিনাম জয়ন্তী উৎসবে সুনামগঞ্জ কলেজের নির্বাচিত ভিপি ও ৭১ এর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমরা সকলে মিলে জনাব হুমায়ূন কবীর চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের পাশাপাশি তাঁকে বিশেষভাবে স্মরনীয় করে রাখার জন্য যেকোন উদ্যোগ গ্রহনে সচেষ্ট থাকবো।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর