প্রথম নোবেল জয়ী মুসলিম বিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুস সালাম

প্রকাশিত: ২:৩৩ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২১, ২০১৯

প্রথম নোবেল জয়ী মুসলিম বিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুস সালাম

মাহমুদ আহমদ : আজ ২১ নভেম্বর। ১৯৯৬ সনের এই দিনে প্রথম মুসলিম নোবেল জয়ী বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুস সালাম অক্সফোর্ড শহরে তাঁর নিজ বাড়িতে সত্তর বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। বিজ্ঞানের জগতে তাঁর প্রধান পরিচয় পরমাণুর মৌলকণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়ার উপলব্ধি সম্পর্কে আবিষ্কারের জন্য।
.
তার জন্ম হয় ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের ঝাং নামে ছোট শহরে (বর্তমান পাকিস্তানে) ১৯২৬ সালের ২৯ জানুয়ারি। তিনি যে অতি মেধাবী ছিলেন তা তাঁর শৈশবেই প্রকাশ পায়। ১৯৪০ সালে পাঞ্জাবের প্রায় ৪০,০০০ প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীর মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাতেও ঝাং শহর থেকে তিনি সারা পাঞ্জাবে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তারপর পড়তে যান লাহোরে সরকারী কলেজে, সেখানে বি.এ ও এম.এ (গণিত) পরীক্ষায় সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পান। তার ফলে একটি বিশেষ সরকারী বৃত্তি নিয়ে সে বছরই উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিলেতে কেমব্রিজের সেন্ট জনস কলেজে পড়তে যাওয়ার সুযোগ পান। সেখানে গণিতে ও পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়ে ১৯৪৯ সালে দু’বিষয়েই প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।
.
এক বছর কেমব্রিজে গবেষণা করার পর তিনি ১৯৫১ সালে একটি ফেলোশিপ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে ইনস্টিটিউট অব এ্যাডভান্সড স্টাডিতে কিছুদিন রবার্ট ওপেনহাইমের সঙ্গে গবেষণা করেন। সে বছরই তিনি কেমব্রিজের সেন্ট জনস কলেজের ফেলো নির্বাচিত হন এবং ১৯৫২ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও পদার্থবিদ্যায় ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি পাকিস্তান ফিরে আসেন এবং পাঞ্জাব বিশ^বিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান নিযুক্ত হন।
.
১৯৫৪ সালে তিনি আবার কেমব্রিজ ফিরে যান এবং ১৯৫৬ সালের শেষ পর্যন্ত সেখানেই গণিতের প্রভাষক হিসেবে কাজ করেন। এই সময়ে তিনি ১৯৫৫ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত শান্তির জন্য পরমাণু শক্তি সম্মেলনের সচিব হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি মাত্র ৩১ বছর বয়সে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পেরিয়াল কলেজ অব সায়েন্স এ্যান্ড টেকনোলজিতে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার প্রফেসর নিযুক্ত হন। সে বছরই তিনি পেলেন তাঁর প্রথম বড় রকম আন্তর্জাতিক সম্মান, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গত তিন বছরে পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জন্য তাঁকে হপকিন্স পুরস্কার দেয়। ১৯৭৯ সালে পদার্থবিদ্যায় তিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। নোবেল পুরস্কার ছাড়া নানা দেশের বহু বিশ^বিদ্যালয় আব্দুস সালামকে সম্মানসূচক বিভিন্ন ডিগ্রীতে ভূষিত করেছেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশেষ সমাবর্তনে তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করে।
.
তিনি ঐশী প্রদত্ত বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি আহমদীয়া মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন সদস্য ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ, খাঁটি ধর্মপরায়ণ এবং কুরআন প্রেমিক ছিলেন। যত ব্যস্ততাই থাকতো না কেন পাঁচ বেলার নামাজ পড়তেন অত্যন্ত আগ্রহের সাথে। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সভা-সেমিনার চলাকালীন নামাজের সময় হলে সোজা উঠে চলে যেতেন নামাজ আদায় করার জন্য। নোবেল পুরস্কার পাবার সংবাদ পেয়ে সর্বপ্রথম তিনি যে কাজটি করেন, তা হলো- লন্ডন ‘মসজিদ ফজলে’ গিয়ে আল্লাহতায়ালার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেন। পুরস্কার পাবার পর তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বলেন-“আমার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে-আল্লাহর প্রতি অপরিসীম কৃতজ্ঞতা, যিনি আমাদের চিত্তমনের নিয়ন্তা।” কোরআন পাঠ ও গবেষণা ছিলো তাঁর সারা জীবনের নেশা।
.
আমরা তার প্রায় প্রতিটি বক্তব্যে লক্ষ্য করি, কালজয়ী মুসলিম বিজ্ঞানীদের কৃতিত্বের গৌরব গাঁথা ৭৫০-১১০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। সুদীর্ঘ সাড়ে তিনশো বছর ছিলো ইসলামী ঐতিহ্যের স্বর্ণযুগ। জাবের আল হাইয়ান, খারেজমী, আলরাজী, আল মাসুদি, আল বেরুনী, আল হিশাম, ওমর খৈয়াম প্রমুখ। প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিলো তখন। অধ্যাপক সালাম সেই ঐতিহ্যকে জাগ্রত করার মূলসূত্র স্বরূপ মুসলিম জাতিকে প্রকৃত আধ্যাত্মিকতায় উদ্বুদ্ধ করার প্রতি জোর দিয়েছেন।
.
তিনি বলেন- নবম, দশম ও একাদশ শতাব্দীতে মুসলমানদের স্বর্ণময় যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাদের সর্বশ্রেষ্ঠতার কারণ হলো- তারা পবিত্র কোরআনের আদেশ অনুসরণ করতেন। তিনি বলেন, যে পবিত্র কোরআনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি ডামাস্কাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ মোহাম্মদ এজাজ আল খাতিবের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন- পবিত্র কোরআনে ২৫০টি আয়াতে বিজ্ঞানের গুরুত্ব বর্ণনা করা হয়েছে এবং ৭৫০টি আয়াতে মোমেনদের জন্য বিজ্ঞান চর্চা, প্রকৃতির রহস্য অনুসন্ধান ও যুক্তিতত্ত¡ অনুসরণের আদেশ দেয়া হয়েছে। অধ্যাপক সালাম মুসলিম দেশগুলোকে তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে গবেষণায় মনোনিবেশ করার জন্য গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান এবং তিনি ইতালীর ট্রিয়েষ্টে তৃতীয় বিশ্বের বিজ্ঞান একাডেমী ও তাত্তি¡ক পদার্থ বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র স্থাপন করেন। দরিদ্র দেশগুলোসহ সারা বিশ্বের তরুন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা এখানে আসেন বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক অগ্রগতি নিয়ে গবেষণা করেন। আর এভাবেই ঝাং-এর সেই তরুন তার ইসলামী বৈজ্ঞানিক রেনেসাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়নের দুয়ার উন্মোচন করে গিয়েছেন। এককথায় ইসলামী গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারের অনুপ্রেরণা তাঁর প্রতিটি রক্ত কণিকায় জ্বলজ্বল করে জ্বলত।
.
নিশ্চয় তিনি তাঁর কর্মের শুভ্র আলোকে বিজ্ঞানের জগতে উজ্জ্বল তারকা হয়ে জ্বলবে। তিনি গোটা মুসলিম বিশ্বের অহংকার। বিজ্ঞান মগ্নচৈতন্য এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ২১ নভেম্বর ১৯৯৬ সনে অক্সফোর্ড শহরে তাঁর নিজ বাড়িতে সত্তর বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। পাকিস্তানের রাবওয়াতে চিরশায়িত অধ্যাপক আব্দুস সালামের আত্মার প্রতি অজস্র ধারায় রহমত ও মাগফিরাত বর্ষণ করতে থাকুন, আল্লাহতায়ালার কাছে এই প্রার্থনাই আমাদের থাকবে।
.
লেখক- মাহমুদ আহমদ: ইসলামী গবেষক ও কলাম লেখক

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

সর্বশেষ ২৪ খবর